1. muktokotha@gmail.com : Harunur Rashid : Harunur Rashid
  2. isaque@hotmail.co.uk : Harun :
  3. harunurrashid@hotmail.com : Muktokotha :
পহেলা বোশেখ, নির্ভিক বাঙ্গালী শক্তির এক অদম্য প্রতীক - মুক্তকথা
বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪১ অপরাহ্ন

পহেলা বোশেখ, নির্ভিক বাঙ্গালী শক্তির এক অদম্য প্রতীক

সংবাদদাতা
  • প্রকাশকাল : শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯
  • ৩৮২ পড়া হয়েছে

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী

১৪ই এপ্রিল পহেলা বোশেখ পালিত হয়। এটি নির্ভিক বাঙ্গালী শক্তির এক অদম্য প্রতীক। 

ছায়ানট, ১৯৬১সালে স্থাপিত বাঙ্গালী মননের একটি প্রধান সাংস্কৃতিক সংগঠন। ছায়ানটই প্রতিনিধিত্বমূলক বিভিন্ন আচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা গানকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

শুভ নববর্ষ, Happy New Year! বাংলা দিনপঞ্জির প্রথম দিন ১৪২৬সালের পহেলা বোশেখে বাংলা নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা সকলকে!
আমার তারুণ্যে, ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে এ দিনটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ফরিদপুরের গোপাল গঞ্জে, যেখানে আমার বাবা মহকুমা কর্মকর্তা(এসডিও) হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ওই দিন, আমরা ভাই-বোনদের বিভিন্ন দোকান ও ব্যবসাকেন্দ্রে নিমন্ত্রণ করা হয় এবং সুন্দরভাবে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন নমুনার চিত্তবিনোদনী মিষ্টি উপহার দেয়া হয়। সেদিন আমার একটি বিষয় খুব মনে লেগেছিল, আর সে বিষয়টি ছিল আমার সুপ্রিয় মিষ্টি জিলেপি আমাদের দেয়া হয়নি। জিলেপি আমার খুব প্রিয় মিষ্টি!

আমাদের জিলেপি দেয়া হয়নি কারণ সেসময় অনেকেই মনে করতেন জিলেপি দামী মানুষের মিষ্টি নয়। সেদিন আমাদের বলা হয়েছিল এদিনে মিষ্টি খাওয়ানো আমাদের সমাজের একটি রীতি বা রেওয়াজ। কারণ এদিন ব্যবসায়ীগন নতুন বছরের জন্য তাদের ব্যবসার হিসাব-নিকেশের পুরোনো খাতা বদল করে নতুন খাতা খুলেন। যাকে ‘হালখাতা’ বলা হয়। বছরের শুরুতে এই নতুন খাতা খোলার নিমন্ত্রণ প্রত্যেক দোকানি ও ব্যবসায়ী নিজ নিজ খরিদদারদের কাছে পৌঁছে দেন। ক্রেতাগন এদিন নতুন খাতায় নাম লিখাবার আগেই পুরোনো সব ঋণ পরশোধ করে নেন। 
খুব উৎসুক্য নিয়ে সেদিন দেখেছিলাম দিনটি বন্ধের দিন নয়। স্কুল, কলেজ কিংবা অফিস-আদালত সেদিন খোলাই ছিল। আমার উৎসুক্যের কারণে আমাদের মা আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানী সরকার এ দিনটিকে উৎসব হিসেবে পালন করতে চায় না শুধুমাত্র লোকদেখানোর জন্য কারণ এই হালখাতা অনুষ্ঠান ইসলামিক প্রথার সাথে মিলেনা।
আমরা যখন ঢাকায় আসলাম, আমি বুঝতে পারলাম এখানেও একই ভাব কাজ করছে। পালিত হয় তবে খুবই নগন্যভাবে। এভাবেই পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ বাংলা প্রথা ও সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু যেকোন ধরনের দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বাঙ্গালী সত্ত্বার চির চেনা কাজ। সুতরাং আমরাও দমন নিপীড়ন প্রতিহত করতে থাকি। 

ছায়ানট, ১৯৬১সালে স্থাপিত বাঙ্গালী মননের একটি প্রধান সাংস্কৃতিক সংগঠন। ছায়ানটই প্রতিনিধিত্বমূলক বিভিন্ন আচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা গানকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ছায়ানটের এ কাজে অনেক মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠে এবং তাদের উৎসাহ দিতে থাকে। এক সময় মানুষের পক্ষ থেকে খুবই উৎসাহ দেয়া শুরু হয় পহেলা বৈশাখ পালনের জন্য। ফলে ১৯৬৭সালের পহেলা বৈশাখ ঢাকার রমনা পার্কে পুরোনো বটবৃক্ষ মূলে প্রথম ‘পহেলা বোশেখ’ পালন করা হয়। সেটিই ছিল রাজধানী ঢাকায় প্রথম বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা।
পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কখনই এর উন্নয়নের দিকে কোন নজর দেয়নি বরং বহুবার এ উদ্যোমকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তারা যতই বাঙ্গালীর এ অদম্য শক্তিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, আমরা ততই প্রচণ্ড শক্তিতে তা প্রতিহত করেছি। ফলে জনসমাগম প্রতিবছরই বাড়তে থাকে। 

পাকিস্তানী আমলে আমাদের বাংলা পঞ্জিকা নিয়ে এতই বিতর্ক ছিল যে আমাকে খুব বেশী করে কৌতূহলী করে তোলে। ফলে আমি এর গভীরে গিয়ে দেখার লক্ষ্যে ইতিহাস খুঁজতে শুরু করি। ইতিহাস আমাদের বলে, বাংলায় মোগল শাসনামলে জমির খাজনা প্রাথমিকভাবে আদায় করা হতো সরাসরি কৃষকের কাছে থেকে ইসলামী হিজরী পঞ্জিকানুসারে। এই হিজরী পঞ্জিকা মূলতঃ চন্দ্রমাস ভিত্তিক এবং প্রায়শই ফসলী সময়ের সাথে বেমিল হয়। স্বাভাবিকভাবেই কৃষককূলেরও সেই নিষ্ফলা চান্দ্রমাসে খাজনা দেওয়া কঠিন হয়ে উঠে।

সম্রাট আকবর তখন সিংহাসনে। একজন বাস্তবাদী শাসক হিসেবে সম্রাট আকবর এ সমস্যার একটি বস্তুভিত্তিক সমাধান চেয়েছিলেন। আকবরের লক্ষ্য ছিল, কৃষকের গোলায় যখন ধান থাকবে আর পকেটে টাকা তখন খাজনা দিতে তার গায়ে লাগবে না। আর সে সময়টাই খাজনা আদায়ের সঠিক সময়। তাই তিনি তার রাজজ্যোতিষী ফতুল্লাহ সিরাজীকে ডাকলেন। ফতুল্লাহ সিরাজী ছিলেন আকবরের নবরত্ন সভার একজন সভাসদ। তাকে ডেকে হিজরী চান্দ্রপঞ্জিকা ও বাংলা সৌর পঞ্জিকার সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটু নতুন পঞ্জিকা তৈরী করতে। এর ফলেই জন্ম হয়েছিল বাংলা পঞ্জিকার। সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খৃঃ এই বাংলা পঞ্জিকা চালু করেছিলেন। তিনি এই পঞ্জিকার একটি নামও দিয়েছিলেন- ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ বা এলাহি পঞ্জিকা।
কিছু কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন রাজা শশাঙ্ক সপ্তম শতাব্দিতে এই পঞ্জিকা চালু করেছিলেন এবং সিরাজী সেই পঞ্জিকাকেই অনুসরণ করে তার ‘ফসলি সন’ বা শষ্যপঞ্জিকা তৈরী করেছিলেন। 
আবার অন্যান্য কিছু ঐতিহাসিকের মতে বাংলার মোগল সুবেদার নওয়াব মুর্শিদ কুলি খাঁ ই ছিলেন প্রথম সেই ব্যক্তি যিনি সম্রাট আকবরের ফসলি সনের খাজনা আদায় কৌশল কাজে লাগাতে গিয়ে বাংলা পঞ্জিকা চালু করেছিলেন। যদিও আরো কিছু ঐতিহাসিক আছেন যারা সম্রাট আকবরকে বাংলা পঞ্জিকা চালুর পুরো কৃতিত্ব দিতে রাজী নন। তারা বহু মন্দিরে রক্ষিত প্রমান ও কাগজাতের উল্লেখ করে বলেন যে এসমূহ কাগজাত বলে দেয় যে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা পঞ্জিকা আকবরেরও বহু আগে মানুষের ব্যবহারে ছিল। মূলে যা-ই থাক না কেনো, এখন এটি প্রতিষ্ঠিত যে আকবরই বাংলাপঞ্জিকা চালু করেছিলেন এবং তারচালুকরা পঞ্জিকাই বাংলাদেশে জমির খাজনা আদায়ের মূল ভিত্তি।

যাই হোক, বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের দ্বারা চালু করা জর্জিয়ান পঞ্জিকাই বর্তমান বাংলাদেশের দাপ্তরিক পঞ্জিকা। কিন্তু সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখের সাথে একটি সমস্যা তৈরী করেছিল। প্রায় প্রত্যেক বছরই সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বছরের প্রথম দিনে ‘পহেলা বৈশাখ’ হতো না বা আসতো না। পরে ১৯৬৬সালে প্রয়াত (ড.) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে তৈরী একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পর্ষদ এ সমস্যার একটি সুরাহা করেছিল। তারা জর্জিয়ান পঞ্জিকার নমুনার(মডেল) সাথে প্রতি ‘লিপ ইয়ার’-এ বাংলা ফাল্গুন মাসে বাড়তি ১টি দিন যোগ করে দেন। ফলে, সেই থেকে বাংলাদেশে প্রত্যেক ১৪ই এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। তবে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ও বাঙ্গালী অধ্যুষিত বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে এ নিয়মে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়না। তারা সৌর আবর্তনের উপর নির্ভর করে ১৪ই কিংবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করে থাকেন। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, পহেলা বৈশাখ উৎসব হিসেবে পালন দাপ্তরিক মর্যাদা পেয়েছে এবং এদিন এখন সরকারীভাবে একটি ছুটির দিন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ জীবনের সকল অবস্থানের মানুষ বিপুল আনন্দ, উৎসাহ উদ্দীপনায় এখন এ দিনটি পালন করে থাকেন। 
সুদীর্ঘ সময়ের চর্চ্চায় এখন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠেছে মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। মানুষ এখানে সমবেত হয়ে তাদের উত্তরাধিকার ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কথা উচ্চারণ করতে পারে। 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ দেখেছে বাঙ্গালী সাংস্কৃতিক প্রথা ও ঐতিহ্যের এক মনোমুগ্ধকর পুনরোত্থান। এটি আমাদের গর্ব যে এসব উৎসব পার্বণের অনেকটাই আমাদের ইতিহাস সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেক্সো দ্বারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। উল্লেখ করা যায় আমাদের মহান ২১শে ফেব্রুয়ারী ‘মাতৃভাষা দিবস’ ও পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। 
এখানে আমি কিছু যুক্ত করতে চাই যে, বৈশাখী উৎসব কেবলমাত্র বাঙ্গালী বিষয় নয়, আমরা নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারে একটু ব্যতিক্রমে বৈশাখী উৎসব পালিত হতে দেখেছি। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে লাহোরে আমার বৈদেশিকসেবা বিষয়ক প্রশিক্ষনের সময় তৃপ্তির সাথে অবাক বিস্ময়ে আমি দেখেছি সেখানেও বোশেখ পালিত হচ্ছে। পাঞ্জাবীরা এ দিনে ঘুড়ি উড়াচ্ছে, নর-নারীগন বাহারী পোষাক পড়ে ঘুরছে আর মহিলারা তাদের হাতে তালুতে মেহদি পড়ে বসন্তের আগমনি ঘোষনা করছে। তাদের সেই উৎসব পালন আমাদের ধ্যান-চেতনা থেকে কোন অংশেই ভিন্ন নয়। 
বাংলাদেশে, “কাল বৈশাখী” বা উত্তর-পশ্চিম ঘূর্ণীঝড় এসময়ই হয়ে থাকে। শীতের জমে যাওয়া সকল বর্জ্য আবর্জনা উড়িয়ে নিয়ে ধূয়ে মুছে সব সাফ করে নির্মল করে দিয়ে যায় এই কাল বোশেখী। বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের কবিতার সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই স্বাগতঃ হে বৈশাখ, এসো আমাদের অতীত দুঃখকে সরিয়ে আমাদের এ বিশ্বকে তার তপ্ত ধূলাবালি থেকে পরিষ্কার করে দিতে এসো। এসো শুভ নববর্ষ। 
এ
সো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।
লিখক: ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার।
আজ ১৩ই এপ্রিল শনিবার আমাদের গৌরব ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সম্মানীত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সাহেব ‘দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ এই নিবন্ধটি লিখেছেন। অতীব সুখপাঠ্য তথ্য সমৃদ্ধ এ নিবন্ধটি তার অনুমোদনক্রমে আমরা অনুবাদ করে এখানে পত্রস্ত করলাম। -সম্পাদক

এ জাতীয় সংবাদ

তারকা বিনোদন ২ গীতাঞ্জলী মিশ্র

বাংলা দেশের পাখী

বাংগালী জীবন ও মূল ধারার সংস্কৃতি

আসছে কিছু দেখতে থাকুন

© All rights reserved © 2021 muktokotha
Customized BY KINE IT