হারুনূর রশীদ॥
বিশ্বের কোন একটি অংশকেও কি স্বর্গ বানানো যায় না, যেখানে থাকবে না জরা-মৃত্যু
কেনো এমন অদ্ভুত ভাবনা জাগে খুঁজেই কিছু পাইনা।
রাতের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আধো ঘুম আধো নেই অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছি। ঘুরে ঘুরে প্রয়াত জীবনসঙ্গী’র কথা ও স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। আমার গৃহলক্ষী চলে গেছে সাড়ে ৭মাস আগে। এখনও তার প্রভাব আমাকে কাঁদায়। আজ অবদি প্রতি সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার রেখে যাওয়া সকল স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় জমায়। বিমূর্ত তার ছবিখানা মনের আয়নায় মূর্ত হয়ে ভেসে উঠে। তাকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় আমার সামনে। এখনও প্রতি ভোরে ঘুমের ঘোরে তার সুরেলা মধুর মিহিকন্ঠের ডাক আমি শুনতে পাই। একটু সোহাগি ঠাট্টা মেশানো কথায় প্রত্যেক ভোরে সে আমায় ডাকতো-এই উঠে গেছো? উঠে পড়ো নাস্তা খাবে না? তার গলার সে স্পষ্ট আওয়াজ আজও ঘুমের ঘোরে আমার কানে ভাসে। মনে হয় আমি যেনো স্পষ্ট সে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমার মনোহারি বিনোদিনী নিদ্রাভঙ্গের জন্য আমায় ডাকছে। মুহুর্ত মধ্যে বুঝতে পারি এ আমার ভ্রম। একটু ঠিক হয়ে নেবার চেষ্টা করি। আপনাতেই চোখে জল এসে যায়। আপনজনের মৃত্যু যে কি মর্মান্তিক বেদনাদায়ক! মনে কাঁটা দেয়! ভেতরটাকে খুঁড়ে খুঁড়ে নিঃশ্বেস করে দেয়।
আজও চোখের পুতুলিতে জলের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দু’এক গণ্ডুষ বেয়ে বালিশে মিশে গেছে। দীর্ঘ সাড়ে ৭মাসের পর এখন এ অবস্থা আমাকে বরং আনন্দ দেয়। এমন না হলে, এখন আমি ভাবি- তা’হলে আমি কি আমার এ মানুষটিকে ভুলে যাচ্ছি। এই ভুলে যাওয়া হয়তো অনেকের কাছে স্বাভাবিক কিন্তু আমার কাছে অস্বাভাবিক। এমন হতেই পারে না। এটি হবে আমার স্বার্থপরতা। কেনো তাকে ভুলে যাবো? সে তো কোন অপরাধ করেনি। মানুষের অনন্ত অজানা জীবনের এটি এক রহস্যময় অধ্যায়। এভাবেই চিরতরে চলে যেতে হয়। আর কোনদিন ফিরে না।
শুধু মানুষ নয় সবকিছুকেই এভাবে বিগত হতে হয়। সৃষ্টি জগতের সে রীতিতেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। এতো তার কোন অপরাধ নয়। তা’হলে কেনো আমি তা’কে ভুলে থাকতে চাইবো? মন বিদ্রোহ করে উঠে। অজানা মনের গভীরে কান্নার আয়নায় বিম্বিত হয় তার সেই হাসিমাখা ছবি। তার সে স্বর্গীয় চেহারা বলে উঠে- ঠিকই তুমি কি আমায় ভুলে থাকতে চাও? এমন অনুভুতি হৃদয়টাকে কান্না ছাড়িয়ে উদাসী ভাবে নিয়ে যায়। মনে দৃঢ়তা এনে ভাবি মানুষের জীবনতো একটাই। যতদিন বেঁচে থাকবো তা’কে সর্বক্ষন মনে রেখেই চলবো। কোন অসুবিধে বা সমস্যাতো কিছুই নেই। চাইলেই তা পারা যাবে। এটি নিজের ইচ্ছার বিষয়। আবারও ভাবনা আসে। ভাবি, অনেকেই নিজের কঠোর কঠিণ সফল কাজের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে থাকে। তবে এর পেছনেও কিছু মানুষকে কাজ করে যেতে হয়।
কিসব দূর্বোধ্য ভাবনা মাথায় কাজ করে নিজেই বুঝিনা।
আজও সেই একই অবস্থায় খুব ভোরে, পুরো ঘুম নয় আবার একেবারে যায়নি। ঘুমে থেকেই বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি। আধো আছে আধো নেই এমন অবস্থায় বলতে গেলে অনেকটা স্বপ্ন দেখার মতই। আধো জাগা অবস্থায় মনের পর্দায় ভেসে উঠলো জীবনসাথী হেলীর চেহারা। যা প্রতিদিনই আমার হয়। দেখি আমি যেনো তার সাথে আলাপ করছি।
সে এক অবিশ্বাস্য গল্পের মত। আলাপের এই পর্বটি আরব্য উপন্যাসের মত উদ্ভট হলেও না হওয়ার মত কিছু নয়। আরব্য উপন্যাসের কাহিনীর অনেক কিছুই যা তখন ছিল কল্পনা এখন তার সবকিছুই বাস্তব। বিজ্ঞান এ পথে চেষ্টা চালালে না পারার কিছু বলে আমার মনে হয় না। দেখি, আমরা বসে বসে ভাবছি-
বিজ্ঞান যদি পারতো এ বিশ্বের কোন একটি এলাকাকে ঘিরে এমন একটি অবস্থা তৈরী করে নেয়া যে, ওখানে যারা থাকবে তারা আর মরবে না। এসব মানুষ চিরজীবী হয়ে থাকবেন। তাদের কিছুই করতে হবে না। তাদের ইচ্ছেমত সবকিছু তারা পাবেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে। অনন্ত অনাদিকাল তারা এভাবে বেঁচে থাকবেন। তাদের সন্তানেরাও চিরজীবী হবে। অবশ্য এই সীমানার বাইরে যারা থাকবেন তারা সাধারণ মানুষ। থাকার যোগ্যতা অর্জন করে নিতে পারলে তারাও এখানে প্রবেশ করতে পারবেন। এখানে থাকার যোগ্যতা পেয়ে গেলে তিনি অমর হয়ে গেলেন। ঘুমের ঘোরে এমনি অচিন্তনীয় আধো জাগা স্বপ্ন। ঘুম থেকে উঠে অবশ্য দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনে মনে বলেছি হায়রে- বেঁচে থাকতে এমন কি আর হবে!
পুরোভাবে ঘুম সেরে উঠে বুঝলাম কত উদ্ভট চিন্তার স্বপ্ন ছিল? কিন্তু আমার মনে হয় মানুষ একদিন এ অবস্থায় পৌঁছাবে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করে মানুষ এমন এক অবস্থায় পৌঁছাবে যে, কেউ আর মরবে না। সকলেই অমৃতের সন্তান হয়ে যাবে। একসময় ধীরে ধীরে সারা দুনিয়াকে এমন অবস্থায় নিয়ে আসবে মানুষ। প্রথমতঃ দুনিয়া নামক এ ভূখণ্ডের একটি বিশেষ অংশকে মানুষ স্বর্গ বা বেহেস্ত বানিয়ে নেবে। মহাবিশ্বজগতের একখণ্ড স্বর্গ। এ স্বর্গে প্রবেশ করতে হলে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে মানুষকে। সে যোগ্যতাই হবে অনন্ত জীবনের মহৌষধ! এ অংশে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু থাকবে না। এ অংশে প্রবেশ করতে হলে মানুষ নিজেকে তৈরী করে নিয়ে আসতে হবে। এই ভূস্বর্গে প্রবেশের যোগ্যতা কতটুকু অর্জিত হচ্ছে মানুষ তার শরীরযন্ত্রে দেখতে পাবে। যারা যোগ্যতা অর্জনের আগে মারা যাবেন তাদের আবার মানব জনম নিয়ে আসতে হবে। আর বিশ্বের বাকী অংশে থাকবে সাধারণ মানব সমাজ। ঘুমঘোরের স্বপ্ন!
লণ্ডন, সোমবার ৪ জানুয়ারী ২০২১
|