মৌলভীবাজার অফিস: সুনামগঞ্জ: শনিবার, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪২৩।।
ভারতের মেঘালয়ে ট্রাক ড্রাইভারদের নির্মম নির্যাতনে নিহত বাংলাদেশী শ্রমিক বশির হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী বড়ছড়া স্থল শুল্ক ষ্টেশনে কয়লা-চুনাপাথর ট্রাক আনলোড ও অন্যান্য শ্রমিকরা কর্মবিরতি , মানববন্ধন কর্মসুচী ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। এ নিয়ে সীমান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে ও ক্ষোভ বাড়ছে। বড়ছড়া শুল্ক ষ্টেশনে জিরো লাইনের এপারে অবস্থান নিয়ে কয়েকশত শ্রমিক বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় মানববন্ধন কর্মসুচী পালনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভারদের বর্বোরিচিত নির্যাতনে বশির হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানায়।
মানববন্ধন চলাকালে ওপার থেকে কয়লা পরিবাহি প্রায় ৫ শতাধিক ট্রাকের সাড়ি জিরো লাইনে বেলা ১২টা পর্য্যন্ত আটকা পড়ে। এসময় ভয়ে ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভাররা ট্রাক ফেলে নিরাপদে ওপারে ফিরে যায়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিজিবি-বিএসএফ এপার-ওপারে জনবল বৃদ্ধি করে অবস্থান নেয়। মানববন্ধন কারীদের লক্ষ্য করে ওপার থেকে কিছু ভারতীয় নাগরিক ও ট্রাক চালকেরা ঢিল ছুঁড়লে কিছুটা উত্তেজনাও লক্ষ্য করা যায়।
মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, ট্রাক আনলোড শ্রমিক সংগঠনের নেতা গোলাম মোস্তফা, আবুল কালাম, তাহের মিয়া, জামাল উদ্দিন, হাবিব, তাজু মিয়া, শফিকুল ইসলাম আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। প্রায় তিনঘন্টা ব্যাপী মানববন্ধন কর্মসুচী চলাকালে শ্রমিক নেতারা বলেন, বশির তেল চুরি করতে ভারতে প্রবেশ করেননি, সে আমাদের মতই হতদরিদ্র পরিবারের একজন শ্রমিক, কাজ না থাকায় পেটের দায়ে চুনাপাথর ভাঙ্গতে গেলে রোববার রাতে জিরো লাইনের এ’শ গহেরর ভেতর ভারতীয় পুলিশের সহযোগীতায় ওখানকার ট্রাক চালকরা মদপান করে উন্মাদ হয়ে আদি যুগের বর্বরতায় বশিরের হাতে কোমড়ে শেকল দিয়ে বেধে রেখে, রাতভর বেধরক ভাবে পিঠিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম ভাবে খুন করে, লাশ থানার সামনেই ফেলে রেখে উল্লাস প্রকাশ করে।
বক্তরা আরো বলেন, ‘বশির অপরাধী হয়ে থাকলে বাংলাদেশ কিংবা ভারতের আদালতেও প্রচলিত আইনে বিচার হতে পারতো কিন্তু ভারতীয়রা কোন আইনে কোন অধিকার বলে একজন নিরিহ শ্রমিককে নির্দয়ভাবে পিঠিয়ে খুন করলো আমরা তার সুষ্ট ও ন্যায় বিচার দাবি করছি।’ এসময় কোন কোন শ্রমিক তাদের বক্তব্যে বলেন, সীমান্তে অবাধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান বন্ধ করলেই কেবল এ ধরণের অনাকাংখিত লোমহর্ষক ঘটনা এড়ানো সম্ভব। শ্রমিক নেতা গোলাম মোস্তাফা তার বক্তব্যে বলেন, যেহেতু বশির কোন দেশের আদালতেই চুরির দায়ে সাজা ভুক্ত হয়নি সেখানে বিজিবি’র টেকেরঘাট কোম্পানীর কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার নিজাম উদ্দিন বশিরকে তৈল চুরি করতে ভারতে গিয়েছিল বলে যে ধরণের অপপ্রচার করেছেন তাতে তিনি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার পাশাপাশী ঘটনার দায় ও কর্তব্য পালনে নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে চাইছেন, আমরা তার এ বক্তব্য প্রত্যাহারে দাবি জানাই।
উল্লেখ্য, রোববার রাতে সীমান্তের ওপারে অবৈধভাবে চুনাপাথর আনতে গিয়ে ভারতীয়দের হাতে ধরা পড়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান বশির। তিনি তাহিরপুর উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নের পাহাড়তলী রজনীলাইন গ্রামের মৃত শুক্কুর আলীর ছেলে। বশিরের লাশ ভারতের মেঘালয় ষ্টেইটের শিলং নিয়ে ময়নাতদন্তের পর মঙ্গলবার রাতে লাশ হস্তান্তর করা হয়।
বিজিবি জানায়, ভারতের বড়ছড়ায়, ওখানকার নাগরিকদের নির্যাতনে নিহত বাংলাদেশী শ্রমিক বশির আহমদের লাশ মঙ্গলবার রাত পৌণে ৮টার দিকে ভারতের ঘোমাঘাট থানাপুলিশ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থানাপুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। এর আগে সুনামগঞ্জ-২৮ বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়ন বিজিবি’র বড়ছড়া-শুল্কস্টেশনের মেইন পিলার ১১৯৯ এ বিজিবি ও বিএসএফ’র ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্টিত হয়। পতাকা বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সন্ধ্যায় ভারতের ঘোমাঘাট থানার ওসি এপারের তাহিরপুর থানার এসআই’র নিকট লাশ হস্তান্তর করেন।
বিজিবি’র পক্ষে নিহত শ্রমিকের লাশ গ্রহন কালে বিজিবি’র সিলেট সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সুনামগঞ্জ ২৮- বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর মাহবুবুল আলম ও ভারতের শিংল ১১ বিএসএফের উপ-অধিনায়ক ফকির চাঁদ সহ বিজিবি-বিএসএফ’র দায়িত্বশীলরা উপস্থিত ছিলেন।
লাশ গ্রহনের পর সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আব্দুল্লাহ আল মামুন বুধবার রাতে বলেন,‘পতাকা বৈঠকে আমরা বলেছি বিএসএফ ক্যাম্পের ১০০ গজের মধ্যে এভাবে একটি মানুষকে পিটিয়ে মারা অমানবিক।’ দুই দেশের প্রচলিত আইনে যদি কেউ অপরাধ করে থাকেন তাহলে তার বিচার হতে পারতো।’
এদিকে তাহিরপুর থানা পুলিশ কর্তৃক সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি শেষে রাত সোয়া ৮ টায় নিহতের স্ত্রী কুলসুমা বেগমের নিকট বশির আহমদের লাশ হস্তান্তর করা হলে রাতেই এলাকার পঞ্চায়েতি কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
নিহত বশিরের বিধবা স্ত্রী কুলসুমা বেগম গণমাধ্যমকর্মীদের নিকট ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমার স্বামী ভারতে তৈল আনতে নয় অন্যান্য শ্রমিকের ন্যায় পেঠের দায়ে চুনাপাথর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো। স্থানীয় বিজিবি’র তৈল চুরির কথা বলে নিজেদের দায় এড়াতে চাইছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার তিন সন্তান এতিম হল। শশুড়-শাশুড়ি বা সংসারে আর কেউ নেই। ঘরে একবেলার খাবারও জুতটনা ঠিকমত। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে মেরে ফেলা হল, এখন আমি শিশু সন্তানদের নিয়ে কেমনে চলমু?’ তিনি বিলাপ করে বলতে থাকেন- ‘আমি আমার স্বামীর নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাই, নির্মম এই হত্যাকান্ডে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। আমি আমার সরকারের কাছে বিচার চাই, আশা করি আমি ন্যায় বিচার পাব।’
সুনামগঞ্জ -২৮ বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়ন, বিজিবি’র ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর মাহবুবুল আলম বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে জানান, ‘বড়ছড়া শুল্ক ষ্টেশনে বিজিবি-বিএসএফ সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে বৃহস্পতিবার পূর্ব নির্ধারিত পতাকা বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও কোন কারন ছাড়াই হঠাৎ করে বিএসএফ বৈঠক বাতিল করে দেয়, আমরা পতাকা বৈঠকের প্রস্তুতি নিয়ে টেকেরঘাটে সকাল থেকেই অবস্থান করছি।’