বিলেতে বসবাসরত রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন মুক্তিযুদ্ধ ও তার নীতিধ্বনি জয় বাংলা, ‘৭২ এর সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এ নিয়ে কোন ছাড় নয় |
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একাত্তরের রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে আয়োজিত মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে জানতে চাওযা হয়, কোটা আন্দোলনের নামে সাম্রাজ্যবাদের অর্থ সাহায্যে নিরীহ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে উস্কানী দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে এই মানুষকেই হত্যা করে সরকারের পতন ঘটিয়ে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার বানোয়াট কাহিনী সাজিয়ে দেশের সংবিধান লংঘন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কি অবৈধ নয়? একাত্তরের রণাঙ্গনের মোট ১৮জন মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে হলভর্তী দর্শকদের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার, বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব গিয়াস উদ্দিনের বিভিন্নমুখী প্রশ্নে অনুষ্ঠানে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। সভাপতি জনাব গিয়াস উদ্দিন বৈষম্য বিরোধী’ আন্দোলন নামের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, জয় বাংলা এগুলো নিয়ে তুচ্চছতাচিচ্লল্য করছেন? একবারও কি ভেবে দেখেছেন, এবিষয়গুলো অস্বীকার আর আমরা নিজেরা নিজেদের অস্বীকার করা কি এক নয়? তিনি বলেন, বৈষম্যের কথা বলে স্বাধীনতাকে আঘাত করছেন? তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে কঠোর ভাষায় বলেন-“বৈষম্যের কি দেখেছেন আপনারা। পাকিস্তানী আমলে পাকিস্তান আর্মিতে ২%ও বাঙালী ছিলোনা, সিভিল সার্ভিসে ছিলোনা ৫%ও। আমরা সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে স্বাধীনতা আনলাম, সেই স্বাধীনতা আজ আপনারা মুছে ফেলতে চান? ভুলে যাবেন না ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা।” ৬ই এপ্রিল, রোববার সন্ধ্যায় পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে সাংবাদিক, রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী ও কমিউনিটির বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে মূল আলোচক ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচয়িতা ও অন্যতম সংবিধাণ প্রণেতা ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের কন্যা ব্যারিস্টার তানিয়া আমির। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বাহাত্তরের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান জয় বাংলা মুছে ফেলতে চায়- এরা কারা? আজকের এই অপশক্তির পূর্বসূরী পাকিস্তানীরা একাত্তরে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়েও যে জাতিকে পরাজিত করতে পারেনি, এরা সেই জাতির স্বাধীনতা নিশ্চিহ্ন করতে চায় আজ ৫৪ বছর পর এসে? তিনি আরো বলেন, বাঙালি একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি। ১৯৭১ এর ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচিত হওয়ার পর ১৭ই এপ্রিল বৈদ্যনাথ তলায় তা আনুষ্ঠানিক ঘোষিত হয়। ভারত সরকার যখন যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগীতায় রাজি হয়, তখনই তাজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের ঐ সহযোগিতা গ্রহণ করেন।
তানিয়া আমির বলেন, পরম বিপদের সময়ও যখন আমাদের পূর্বপ্রজন্ম জাতীয় আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপোষ করেননি, সেখানে আজ ৫৪ বছর পর এসে কারো হুমকি ধামকিতে ঐ প্রজন্মের উত্তরসূরীরা ভয় পেয়ে যাবে এটি যেন কেউ না ভাবে। তিনি বলেন, বারবার আমাদের স্বাধীনতার উপর আঘাত আসে, বারবার আমরা তা প্রতিরোধ করি। এর কারন আমরা শত্রুদের ক্ষমা করে দেই এবং তারা এই ক্ষমার সুযোগে বারবার হিংস্র হওয়ার সুযোগ পায়। টেলিভিশন উপস্থাপিকা ঊর্মি মাজহারের উপস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লক্ষ মানুষ, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাসহ সকল শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে নিরবতা পালনের মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠান। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফয়জুর রহমান খান, আবু মুসা হাসান, দেওয়ান গৌস সুলতান, লোকমান হোসেন, সৈয়দ গোলাম আলী, ছাদ উদ্দিন আহমদ, আলাউদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক, ইঞ্জিনিয়ার মেফতাহুল ইসলাম, এম এ মান্নান, মো: মোস্তফা, আশরাফ উদ্দিন ভূঁইয়া, মুখলেসুর রহমান দেওয়ান, ফেরদৌস খান হুমায়ূন কবির, কবির আহম্মদ ও হিমাংশু গোস্বামি প্রমুখ। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান বলেন, আজ আমরা ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি এমন এক সময়ে যখন আমাদের প্রিয় দেশমাতৃকার স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে, যখন আমাদের অহংকার ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি উঠে পড়ে লেগেছে। আবু মুসা হাসান বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ– যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার নির্দেশ, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম” সমগ্র বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। তিনি বলেন, দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সাত বীর শ্রেষ্ঠের ম্যুরাল। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম বাগানে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্মৃতি বিজড়িত মুজিবনগরের স্থাপনাগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ওরা জানেনা, বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি বাঙালির হৃদয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা’কে মুছা যাবেনা। আবু মুসা হাসান আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। আমরা যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন এই অহংকার এবং গর্বকে নিয়েই বেঁচে থাকবো। আমরা ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান জয় বাংলা, ‘৭২ এর সংবিধান, জাতির জনক, জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় পতাকার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবনা। অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণের ফাঁকে ফাঁকে ছিলো দেশাত্ববোধক গান ও আবৃত্তি। উল্লেখ্য, টেলিভিশন উপস্থাপিকা ঊর্মি মাজহারের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান শুরু হয় সভাপতির আসন গ্রহন ছাড়াই। পরে আবু মুসা হাসান সভাপতির আসন গ্রহনের প্রস্তাবনা নিয়ে মঞ্চে আসেন। |