হারুনূর রশীদ: ১৮ই মে ২০১৬ সময়: ১টা
আমার মাতৃকূলে শিক্ষক আর বাবার দিকে উকীল আছেন। আমি নিজেও সাংবাদিকতার পাশাপাশি আইন ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলাম। আমার এক সম্পর্কিত চাচা এখনও আমাদের ছোট্ট শহরে উকালতি ব্যবসায় আছেন। আমার ছোটবেলায় আমি দেখেছি আমাদের এলাকায় শিক্ষক আর উকীলদের কি সন্মান। তবে উকীলদের চাইতে শিক্ষকের কদর ছিল বেশী। রাস্তায় হাটতে গিয়ে দেখতাম সালাম আর আদাব যত হচ্ছে সব কোন না কোন শিক্ষককে ঘিরে। আর কোন পেশাকে মানুষজন এতো শ্রদ্ধার চোখে দেখতো না তখন। শিক্ষক বলতেই আমরা বুঝতাম আদর্শ মানুষ। আমার মনে আছে সেই ছোটবেলায় আমাদের শহরে শিক্ষক আর উকীলদের মধ্যে “মর্নিং ওয়াক”এর অভ্যাস ছিল। দু’একজন ডাক্তারও যে সে “মর্নিংওয়াক”এ শরিক হতেন না তা’নয়। তবে শিক্ষকদের সংখ্যা থাকতো বেশী। আমাদের ছোট্ট শহরে গড় সংখ্যায় ডাক্তার উকীলদের চেয়ে শিক্ষক ছিলেন বেশী। প্রতি ভোরে, বিশেষকরে গ্রীষ্ম, শীত, হেমন্ত শরত ও বসন্তে আমরা দু’ভাই “মর্নিংওয়াক”এ আমাদের মামার সাথে বেড় হতাম শহরে। তখনই চোখে পড়তো আমাদের শিক্ষকদের। তারাও সকালের ভ্রমণে বের হতেন। আদরের কড়া নজর রাখতেন তাদের ছাত্রদের প্রতি। বেলা সকাল ৮টার মধ্যে প্রাতঃভ্রমণের কাজ সেরে নিতেই হতো। এ সময়ের পর কোন ছাত্রকে রাস্তায় পেলে শিক্ষক খুব সাবধানে সেই ছাত্রের খোঁজ নিতেন, কে সে? কেনো এখনও ঘরে যায়নি ইত্যাদি। স্কুল থেকে ঘরে অভিবাবককে খবর দেয়া হতো। ডেকে নিয়ে জানানো হতো এবং জানার চেষ্টা করা হতো কোন সমস্যা আছে কি-না! এমনতরো স্কুল আর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমরা পেয়েছি।
একবার, সে তখন ১৯৬৫ কি ‘৬৬সালের কথা কিংবা আরো কিছু আগেরও হতে পারে। আমাদের শ্রীনাথ মধ্যবঙ্গ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া তার এক ছাত্রকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিলে উক্ত ছাত্রের মুসলিম লীগের ঘনিষ্ট সমর্থক, আমাদেরই এক সহপাঠীর উকীল বাবা ঐ শিক্ষককে, কথা কাটাকাটি করে এক ঘা থাপ্পর বসিয়ে দেন। আর যায় কোথায়! সারা শহরের অভিবাবক-শিক্ষক এমনকি সকল উকীল মিলে তাড়াহুড়া করে স্থানীয় এসডিও মহোদয়ের সহায়তায় শিক্ষকের কাছে প্রকাশ্য সভায় ক্ষমা চাওয়ার বিনিময়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করেন। সমাজের সকলেই শিক্ষকদের এমন এক সন্মানের চোখে দেখতেন। সকলেই তাদের সমীহ করে কথা বলতেন। আবার সভাসমিতিতে আমরা ছোটরাও দেখতাম উকীল সাহেবগন শ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে আমন্ত্রিত হতেন। কোন সংঘ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করা হতো একজন উকীলকে সাথে এক’দুজন মাষ্টার অবশ্যই থাকতেন। শিক্ষকদের অবশ্য সরাসরি রাজনীতির ময়দানে কখনও দেখিনি। দেশে কোন নির্বাচন আসলে উকীল সাহেবদের কাছে যাওয়া হতো নির্বাচনে প্রার্থী হবার আমন্ত্রণ নিয়ে। শিক্ষিত-মূর্খ সকলেই এই বিষয়টি বুঝতেন যে জনপ্রতিনিধি জ্ঞানী আইনজানা মানুষ হওয়াই উপযুক্ত। আমাদের পৌরসভার সর্বপ্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন বিলেত ফেরত একজন স্বনামধন্য উকীল। সাংসদ ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিক ঢাকা হাইকোর্টের একজন খ্যাতিমান উকিল। এখনও যে সেই মানুষজন কিংবা শিক্ষক নেই তা অবশ্যই নয়। বহু আছেন। শুধু যোগ্যদের যোগ্য আসনে দেখতে চান এসব গুণীজন। নিম্নবর্গের কাঁদাছুড়াছুড়িতে শরিক হতে এদের বিবেকে বাধে।
বাঙ্গালী সমাজ সংস্কৃতিতে, আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই তা’হলে অবশ্যই দেখতে পাবো অন্যান্য কোন পেশার কথা তেমন নেই কিন্তু শিক্ষা গুরুর কথা সর্বত্রই আছে। শিক্ষা আর শিক্ষক বা গুরুকে বাঙ্গালী সমাজ-সংস্কৃতি সেই অতিপ্রাচীণকাল থেকেই শ্রদ্ধার এক বিশেষ আসন দিয়ে এসেছে। সহস্রাব্দিকালের এই মণি-ঋষি-গুরু তথা জ্ঞানী-গুণী-তপস্বীদের ভক্তিবাদী চর্চ্চার ভেতর দিয়েই আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আমার ছোটবেলায় আমি নিজে দেখেছি আমাদের গ্রামে শিক্ষকের স্থান কোথায়। আমার নিকট-বড়দের মধ্যে কথা শুনতাম, তারা মাঠে খেলার অবসরে গল্প করে বলতেন, লিখা-পড়া শেষে তারা “মাষ্টার” হবেন। আমার কৈশোরে একজনকে আমার মনে পড়ে, আমাকে ভাগনেয় বলে শুধাতেন, দেখেছি তিনি জীবনে মাষ্টার হবার স্বপ্ন এমনভা্বেই দেখতেন যে মরণের আগ পর্যন্ত শুধু মাষ্টারীর জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে অন্য কোন চাকুরীতেই যাওয়ার সময় পাননি। গ্রাম ভিত্তিক আমাদের বাঙ্গালী সমাজের প্রাণপুরুষ ছিলেন গুরু বা মাষ্টার। গ্রামের বিচার-আচার সবকিছুতে মাষ্টার মহাশয়ের ভূমিকা ছিল অনন্য। এমন এক আদরণীয় আর সন্মানিত পদবি ছিল “মাষ্টার”। শুধু তাই নয়, “মাষ্টার” ধ্বনি মধ্যে মানুষের এতো ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর কিছুতে দেখিনি। অবশ্য ইতিহাসের পরতে পরতে কিছু ব্যত্যয় যে নেই তা নয়।
কোন ব্যত্যয় ছাড়া এই ভূমন্ডলের যেগুটিকয় জাতিগুষ্ঠী বিশ্বসভায় আসন করে নিতে পেরেছে তাদের কেউই ভিন্ন জাতিগুষ্ঠী কর্তৃক পদানত হয়নি, অনেকেই হয়নি লুন্ঠিত। বিভিন্ন কারণেই এরা স্বকীয়তা বজায় রেখে ধীরে ধীরে নিজস্ব ভাবধারায় গড়ে উঠেছে। এখন তারা তাদের সেই ভাবধারাকে ফেরি করে বেরাচ্ছে সারা পৃথিবীময়। আমাদের বেলায় হয়েছে তার উল্টো। বহিরাগত বিভিন্ন জাতিগুষ্ঠী দ্বারা বিগত হাজার বছর ব্যাপী দখল আগ্রাসন আর লুন্ঠনের কারণে আমরা আমাদের নিজস্ব ভাবতত্ত্বে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠতে পারিনি। আমাদের বার বার মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে বিজাতীয় ভাবধারার আগ্রাসনের কাছে। আমাদের স্বকীয়তাকে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠতে না দেয়ার বিদেশী কূটনৈতিক চালের সুযোগে কিছু ধূরন্ধর স্বার্থপর দুষ্ট প্রকৃতির লোক সমাজপতি হয়ে বহিরাগতদের নির্দেশেই চলেছে যুগ যুগ। গড়েছে নিজ ভাগ্য। ফলে সমাজ-স্বকীয়তা নিজ শাখা-প্রশাখায় প্রস্ফুটিত হয়ে মজবুত বৃক্ষ হিসাবে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু সত্যনিষ্ঠ কল্যাণমূখী আমাদের ভাবাদর্শের সুপ্ত সমাজ প্রকৃতি নিজ বৈশিষ্টে বাহিরের
সহনশীল অনেক কিছু্কেই আত্মস্ত করে নিতে পেরেছে। আমাদের গোল বেঁধেছে এখানেই। এই আত্তীকরণে ভাল মন্দ দু’টিই জায়গা করে নিয়েছে। এরপরও বলতেই হয়, হাজার বছরের লুন্ঠন আগ্রাসনের পরেও আমরা বাঙ্গালীরা এখনও আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব ভরে টিকে আছি। আর সেই সংস্কৃতি হলো জ্ঞানী-গুণী-তপস্বীদের সংস্কৃতি। গুরু বা শিক্ষককে শ্রদ্ধা করা, তার প্রতি শ্রদ্ধাভরে বিনয় প্রকাশই আমাদের সংস্কৃতির মূল শিক্ষা। সেখানে শিক্ষককে অবমাননারতো কোন স্থানই নেই।
অন্যবিদ আধুনিক পদশ্রী বিশেষকরে সাংসদ পদশ্রী’র সাথে আমাদের পরিচয় এই সেদিনের। কিন্তু শিক্ষক বা গুরু ধ্বনির সাথে আমাদের পরিচয় বৈদিক যুগেরও আগ থেকে। গুরু দক্ষিনা দুনিয়াকে আমরা শিখিয়েছি। তা’হলে এতো উচ্চ মার্গীয় পদ এই “সাংসদ” নামে এরা কারা? কিভাবে এরা আইন প্রণেতা হবার সুযোগ পায়?? যারা এদের মত ইতর প্রাণীদের আইন প্রণেতা হবার সুযোগ করে দেন তারাইবা কারা আর তাদেরকে কি বলা যায়???
নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার স্কুলের শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় কয়েকটি প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে জাগে আর সেগুলো হল প্রথমতঃ সেলিম ওসমান নামের ঐ সাংসদ কোন ক্ষমতাবলে কিংবা আইনের কোন ধারায় একজন কর্মরত শিক্ষককে “কান ধরে উঠ-বস” করার মত এ ধরনের নিদারুণ, চিরজীবনের জন্য সন্মানহানির মত এতোবড় শাস্তি দিতে পারেন? তার সাধারণ জ্ঞান কি একটি বারের জন্যও ভেবে দেখলোনা যে এই নমুনার শাস্তি ঐ শিক্ষকের সারা জীবনের সকল অর্জনকে চিরতরে ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে।
তিনি কি একবারও ভাবেননি যে তিনি কি করছেন?আদৌ তার ক্ষমতা আছে কি নেই?
দ্বিতীয়তঃ এরা কারা ছিল, যারা ঐ শিক্ষককে কোন আইনের বলে সুদীর্ঘ পাঁচ-ছয় ঘন্টা সময় একটি কামড়ায় আটকে রাখে? আবার কোন অজানা কারণে পুলিশ ঐ শিক্ষককে উদ্ধার করতে পারেনি? পুলিশের অসহায়ত্বটি সেদিন কি ছিল?
তৃতীয়তঃ ধর্মের প্রতি কোন কটুক্তি করে থাকলেও একারণে তার প্রাণহানীর হুমকি কি কেউ দিতে পারে? লাঞ্চিত করাতো অনেক পরের কথা? আবার ঐসকল লোকজন, এরা কারা যারা একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি মারাত্মক কটুক্তি করেছেন বলে বাজারে রটালো এবং প্রাণহানীর হুমকি প্রদান করেছিল?
আসার বিষয়, উচ্চ আদালত জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রশ্নে রুল জারী করেছেন।