হারুনূর রশীদ: মুক্তকথা: রোববার: ২২জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩বাংলা, ৫ই জুন ২০১৬ইং: সময়:১১টা ১৫মিনিট
একটি খুনের মামলা। কোন লুকিয়ে খুন নয়, এ যে প্রকাশ্য দিবালোকে দলবেঁধে বাড়ীতে ঢুকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা! শুধুই আইন হাতে তোলে নেয়া নয়, এ যে রীতিমত আইয়ামে জাহেলিয়াতি কাজ!! আফ্রিকা আর আমাদের কথিত উপমহাদেশ ছাড়া বাড়ীতে ঢুকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা আমার মনে হয় না আর কোন দেশে আছে বলে, অন্তত: আমরা জানিনা।
হ্যাঁ, এই মোহাম্মদ আকলাখ হত্যাকান্ডের কাহিনীই বলতে যাচ্ছি। আগামী কাল তার শুনানী হবে আদালতে। এই হত্যা ঘটনাই, ভারতের উত্তর প্রদেশে ভোটের ঢোলে বারি পড়ার অাগেই পুনঃ সামনে চলে আসছে। আকলাখ হত্যাকান্ডের প্রায় ৮মাস পর দ্বিতিয় দফায় মথুরা, উত্তরপ্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের “ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি” গত মঙ্গলবারে তাদের গবেষণার ফল জানালো এই বলে যে খুন হয়ে যাওয়া আকলাখের ঘরের বাহিরে যে মাংস পাওয়া যায় তা গরুর মাংস বা গরু জাতীয় পশুর মাংসই ছিল।
গেল বার, এই প্রায় ৮মাস আগে ২০১৫ সনের ২৮শে সেপ্টেম্বর, দাদরি গ্রামের মোহাম্মদ আকলাখ নামের এই মুসলমানকে গরুমেরে মাংস খাবার দায়ে বর্বরোচিতভাবে, বলা হয় বিজেপি সন্ত্রাসীরা তার বাড়ীতে ঢুকে হত্যা করে। তার ছেলে মাথায় মারাত্মক জখম নিয়ে কোন রকমে বেঁচে যান।
দ্বিতীয় দফায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারী অভিমত সম্পর্কে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এভাবে লিখেছে-“Result- On the basis of chemical analysis the sample belongs to cow or its progeny.”।
সুবিচার হতে পারে এমন আশার বিষয়, সংশ্লিষ্ট একজন উকীল বলেছেন, আগামী কাল ৬ই জুন সুরুজপুর আদালতে যে শুনানী হবে তার সাথে এই রিপোর্ট বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারী অভিমতের কোন সম্পর্ক নেই কারণ মামলাটি মানুষ হত্যার, একটি খুনের মামলা।
সর্বশেষ, ২০১৫ সালের ৩রা অক্টোবর উত্তর প্রদেশ পশুপালন ও পশুচিকিতসা বিশ্ববিদ্যালয়, মথুরা জেলার “ফরেন্সিক তদন্ত ল্যাবরেটরি” এই ডাক্তারীমত জ্ঞাত করে। যা কি-না অখিলেশ সিংহ যাদব সরকারেরই অধীনে থাকা মথুরার একটি ল্যাবরেটরি।
উত্তরপ্রদেশে ভোটের ঢাকে বাড়ি পড়ার মুখেই ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল দাদরির ঘটনা। মোহাম্মদ আখলাক হত্যার প্রায় আট মাস পর ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি রিপোর্ট জানাল, গোমাংস বা সেই গোত্রেরই কোনও মাংস ছিল তাঁদের বাড়ির ফ্রিজে। রিপোর্টটি দিয়েছে অখিলেশ সিংহ যাদব সরকারেরই অধীনে থাকা মথুরার একটি ল্যাবরেটরি।
অথচ গত সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষিপ্ত জনতা আখলাককে পিটিয়ে মারার পরে তাঁর বাড়িতে পাওয়া মাংস প্রথমে পরীক্ষা করেন গ্রেটার নয়ডার এক ভেটেরিনারি অফিসার। তাঁর রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ওটা পাঁঠার মাংস। এদিকে অভিমতে “ফ্রিজ” বলা হয়েছে আবার পত্রিকান্তরে দেখা যায় বাড়ীর বাইরে মাংস পাওয়া গিয়েছিল।
তখন রাজ্যের ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টি ও বিজেপি-বিরোধী সব দলই সন্মিলিতভাবে অভিযোগ তুলে বলেছিল, সাম্প্রদায়িকরাই গোহত্যার গুজব ছড়িয়েছে। এসব আরএসএস ও বিজেপি’র কাজ। অনেকে এখনও মনে করেন এগুলো তাদেরই কাজ। যদিও ৮মাস পর বিশেষজ্ঞ অভিমত বদলে গিয়ে নতুন অভিমত এসেছে এতে হায় হোতোস্মি করার যেমন কিছু নেই হতোদ্যম বা হতভম্ব হবারও কিছু নেই। কারণ একটাই, আমাদের এতোদঞ্চলে হয় না এমন কিছুই নেই। সবই হয়। অবশ্য রাজ্য সরকারেরই অধীনে থাকা ল্যাবরেটরির এই বিপরীত রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ ও তার দলকে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ফেলবে।
উত্তরপ্রদেশে গোহত্যা বেআইনি কাজ কিন্তু গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে দাদরির বিসারা গ্রামে আখলাকের বাড়িতে গোহত্যা করা হয়েছে এমন গুজব রটনার ফলে সাম্প্রদায়িক গুষ্ঠী আখলাকের বাড়িতে হামলা চালিয় ৫২ বছর বয়সি আখলাককে পিটিয়ে হত্যা করে। বিরোধীদের তুমুল নিন্দার মুখে চাপে পড়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার, দাদরির ঘটনাকে দুঃখজনক আখ্যা দিয়ে দায় ঠেলে দেয় প্রদেশের অখিলেশ সরকারের দিকেই। ফলে, এক বিজেপি নেতা-সহ ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বিতর্কের ঝড় ওঠে দেশ জুড়ে। কেন্দ্রীয় মুদী সরকার যুক্তি দেখান যে, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখাটা রাজ্যের দায়িত্ব। তাতে অবশ্য সমালোচনা বন্ধ হয়নি।
আখলাকের ছোট ছেলে দানেশ সম্প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করেন ‘হিন্দুত্ববাদী’রা এই মামলাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। সম্ভবতঃ এ কারণেই নতুন বিশেষজ্ঞ অভিমত হাজির করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। এখন এই গোমাংসের প্রমাণ হাজির করায় দক্ষিণপন্থিদের ঢোলে বাড়ি পরবে।
আখলাকের হত্যার পরে তাঁর পরিবার গোহত্যার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছিল। নতুন করে এই অভিমতে, পুলিশের দাবি উড়িয়ে দিয়ে আখলাকের ভাই চাঁদ মহম্মদ বলেছেন, ‘‘ওটা পাঁঠার মাংস, দাদরি পুলিশই প্রথমে বলেছিল, । কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, গরুর মাংস। পুরোটাই আসলে রাজনীতি।’’
ঘটনার পরপরই প্রাদেশিক সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে আখলাকের পরিবারকে জমি ও নগদ ৪৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিল।
প্রশাসনের তরফে রাজ্যের পুলিশ-প্রধান জাভেদ আহমেদ ঠিকই বলেছেন যে প্রথমেতো জানলাম ওটা পাঁঠার মাংস। এখন দেখা যাচ্ছে, গোমাংস বা সেই গোত্রের মাংস বলে অভিমত আসছে। হোক, তাতে তো আর মানুষ পিটিয়ে খুন করার মতো ঘটনা ছোট হয়ে যায় না। একই কথা বলেছেন আখলাকের পরিবারের আইনজীবী ইউসুফ সইফিরও। তিনি বলেছেন, মথুরার ল্যাবরেটরি মাংস নিয়ে কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। মামলাটা খুনের।
বলতে হয় রাজনীতির রকমফের! এখন দুনিয়াব্যাপী প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা হয়ে উঠেছে ভোটে জেতার প্রধান কৌশল। ছোট-বড় কিংবা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই ভাবেন একটি লাশ হলেই হয়। এ যেনো ভোট বৈতরণী পাড় হবার এক মহৌষধ। আবারো আক্ষেপ করেই বলতে হয়- হায়রে মানুষ! (দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে সংগৃহীত)