আব্দুল ওয়াদুদ।। রাজনগরের রাজু হত্যা মামলায় জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। হত্যা মামলার এজাহারের কিছু স্পর্শকাতর শব্দ বদল করে তা হাইকোর্টে জমা দিয়ে ১০ আসামির জামিন নেয়ার ঘটনা নিয়ে সিলেট ও মৌলভীবাজারে তোলপাড় শুরু হয়েছে। জালিয়াতির বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন, আবেদনের ওপর শুনানি হচ্ছে। গত ১৪ই জানুয়ারী একটি সংবাদ মাধ্যমে এমন খবর ছাপা হয়।
জানা গেছে, গত সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন ১১ই আগস্ট রাজুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর ১৪ আগস্ট সোমবার রাতে নিহত রাজুর চাচা আওয়ামী লীগ নেতা দবির আলী ২৩জনের নাম উল্যেখ করে কোতয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর পুলিশ এজাহারনামীয় তিন আসামিকে গ্রেফতার করে। এই তিনজনের একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়। এ মামলার অন্যতম আসামী ফাহিম আহমদ তোহাকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। তোহা মামলার ১৮ নং এজহার নামীয় আসামী বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার রাতে এসএমপি’র এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সত্যতা নিশ্চিত করে এসএমপি’র এয়ারপোর্ট থানা ওসি শাহাদাত হোসেন।
মামলায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সদস্য, সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রকিব চৌধুরী ও মহানগর ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিনারকে আসামি করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাফি আহমদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্টে জামিন আবেদনের সময় এজাহারের হুবহু কপি দাখিল করতে হয়। সেখানে আসামিপক্ষ জামিন পাওয়ার জন্য বেশকিছু শব্দ পরিবর্তন করে এজাহারের অর্থগত ও গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। আসামিপক্ষের আইনজীবী জালাল উদ্দিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পরিবর্তন নয়, এটা টাইপিং মিসটেক। যেহেতু বিষয়টি এখন আদালতে আছে, তাই বলারও কিছু নেই।
বিশ্বস্ত এক সূত্র থেকে জানা যায়, এজাহার বদল করে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর আসামিদের পক্ষে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল হাফিজ ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের যৌথ বেঞ্চ তাদের দুই সপ্তাহের আগাম জামিন দেন এবং নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরে জামিনের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে এই জালিয়াতির বিষয়টি ফাঁস হয়। এ অবস্থার পর, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৭৬ নম্বর ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য হাইকোর্টের একই বেঞ্চে ২ জানুয়ারি আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
হাইকোর্টের নির্দেশে গত ১৯শে ডিসেম্বর জামিনপ্রাপ্ত ১০ আসামির মধ্যে ৯ জন সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইব্রাহিম মিয়ার আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করে। পরে বিচারক তাদের ৯ জনকেই কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরা হলো- এনামুল হক, একরামুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান, শেখ নয়ন, আরাফাত এলাহী, ফরহাদ আহমদ, নজরুল ইসলাম, আবজল আহমদ চৌধুরী ও মামুন আহমদ। এসময় মামলার দ্বিতীয় আসামি ছাত্রদল নেতা দেলওয়ার হোসেন দিনা আত্মসমর্পণ না করে পালিয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়ীত্বশীল একজন বলেন, মামলার এজাহারের কপিটি খতিয়ে দেখা যায়, “সেখানে জখমী উজ্জল এবং রাজুকে সমূহ আসামিগণ ঘিরিয়া ফেলে”-এর স্থলে ‘জংগী’ উজ্জল এবং ‘বাচ্চুকে ফিরিয়া ফেলে’, আসামী দিনার তাহার হাতে থাকা ধারালো চাপাতি দিয়া ফয়জুল হক রাজুর মাথার পিছনেসহ প্রাণে হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপরি কুপাতে থাকে-এর স্থলে ‘দিলার’, আসামি মফজ্জুল উরফে মুর্শেদ-এর স্থলে ‘ফয়জুল উরফে মুর্শেদ’, আসামি সলিড-এর স্থলে ‘রকিব’, জখমী উজ্জল-এর স্থলে ‘আসামী উজ্জল’, রাজুকে উদ্ধার-এর স্থলে ‘হত্যা’, আসামি এনামুল ভিকটিম রাজুর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বন্দুক দিয়া-এর স্থলে ‘রাজুর বন্ধুক’, আসামি মুহিবুর রহমান খান রাসেল-এর স্থলে ‘মাহমুব রহমান খান রাসেল’সহ বিভিন্ন স্থানে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘অর্থগত ও গুণাগুণ পরির্বতন’ করা হয়েছে।”
এ নমুনার জালিয়াতির মধ্য দিয়ে আসামিপক্ষ এজাহারকে দুর্বল ও অসম্পূর্ণ দেখিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে সক্ষম হয় বলে দাবি মামলার বাদী দবির আলীর। তিনি আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।
মামলার প্রধান আসামি ছাত্রদল নেতা আবদুর রকিব চৌধুরীসহ ১১ জনকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে মামলার বাদী দবির আলী জানান, পুলিশের গাফিলতিতে প্রধান আসামি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। গ্রেফতার ৯ জনকে দু’দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও পুলিশ তাদের কাছ থেকে হত্যার কোনো তথ্যই উদঘাটন করতে পারেনি। এমনকি এই দীর্ঘ সময়েও রাজুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয়নি। তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের দ্বিতীয় আসামি দিনারসহ বাকিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। আসামিরা বাইরে থাকায় আমরা আতঙ্কে আছি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কোতোয়ালি থানার এসআই অনুপ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ৯ জন আসামিকে দু’দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। তদন্ত চলছে। বাকি আসামিদেরও গ্রেফতারের তৎপরতা অব্যাহত আছে।