কোন মানবগুষ্ঠীর অভ্যন্তরে বিদ্যমান বিরোধকে তীব্র করে দিয়ে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে সেই ঘোলাজল থেকে নিজেদের ফায়দা লুটা, স্বার্থ আদায় করে নেয়া একটা বহুল প্রচলিত রাজনৈতিক তত্ত্ব।কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, বিশ্বের প্রায় সকল মানব সমাজেই এর প্রকাশ্য প্রচলন বা ব্যবহার রয়েছে। যদিও মাছ শিকার করতে হলে জল ঘোলা করে নেয়াই ভাল তার পরও সকল সমাজের জ্ঞানী গুণীরা এমন জলঘোলা করে স্বার্থ আদায়কে কোন আমলেই স্বীকৃতি দেয় নি। কিন্তু স্বীকৃতি না দিলে কি হবে, জল ঘোলা করে নিজের স্বার্থ হাতিয়ে নেয়ার এমন অপকৌশল সভ্য মানব সমাজে আগেও ছিল এখনও আছে এবং সম্ভবতঃ ভবিষ্যতেও থাকবে।
ভারতে বিজেপি নামের রাজনৈতিক গুষ্ঠী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এমন রাজনীতি প্রকাশ্যে করে যাচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক দশকের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অনুশীলনে ভারত মোটামুটি একটি সঠিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিজেপি ক্ষমতায় এসেই এমন মাত্রায় সাম্প্রদায়িক উস্কানি শুরু করে যে অল্প কয়েক বছরের মাথায় সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। গুজরাটের মুসলিম নিধন, বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা সর্বশেষ কাশ্মিরে দখলাভিযান তারই প্রকাশ্য দগদগে ক্ষত! এই ক্ষত যাতে শুকিয়ে না যায় বরং আরো বেড়ে উঠে সে রকম একটি গরল চিন্তা থেকে বিজেপি নতুন করে সামনে নিয়ে আসে ইতিহাস খ্যাত “আকবর দি গ্রেট” অর্থাৎ সম্রাট আকবরকে। তাদের চেষ্টা আকবরকেও খলনায়ক বানানো। একজন কলুষিত চরিত্রের মানুষ বানিয়ে ভারতের মুসলমান জনগুষ্ঠীকে আরেক দফা ধমক দেয়া। মূল উদ্দেশ্য সহিষ্ণু ভারতকে অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের আদলে গড় তোলা। বিগত ২০১৯সালের ৭জুন তারিখে সামাজিক মাধ্যম “আউটলুক” অনলাইন রাজস্থানের বিজেপি প্রধান মদনলাল সাইনির উপর পুরো পাতা জুড়ে খবর প্রকাশ করেছিল। সে খবরে মদনলাল বলেছিলেন যে আকবরের আমলে যে নওরোজ উৎসব হত সে উৎসব ছিল শুধু মহিলাদের জন্য। উৎসবে কোন পুরুষ যেতে পারতেন না। কেবলমাত্র ছদ্মবেশে সম্রাট উৎসবে যেতেন। সেখানে আকবরের কোন মহৎ উদ্দেশ্য তো ছিলই না বরং দূস্কর্ম চরিতার্থের জন্য তিনি সেখানে যেতেন। মেওয়ারের রাজা মহারাণা প্রতাপ সিং-এর জন্মবার্ষিকী পালনের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই বিজেপি প্রধান বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষী দাড় করিয়ে আরো বলেছিলেন যে, এক নওরোজ মেলায় মহারাণা প্রতাপের চাচাতো বোন বিকানুরের পৃথভিরাজের স্ত্রী কিরণ দেবী যখন মেলায় একাকী পায়চারী করছিলেন সে সময় আকবর তার পিছু নেন এবং তাকে সম্রাটের সাথে এক রাত কাটানোর প্রস্তাব দেন। কিরণ দেবী এক পর্যায়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে আকবরকে মাটিতে ফেলে দেন এবং তার বুকে পা চেপে লুকিয়ে রাখা চাকু বের করে আকবরের পরিচয় জানতে চান। আকবর তখন তাকে বলেন তোমার পায়ের নিচে ‘হিন্দুস্তানের সম্রাট’! অবশেষে আকবর ক্ষমা চেয়ে নেন। ওই দিন আর নওরোজ মেলা চলেনি। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক একই ঘটনাকে দু’বছর পর কৌড়া ডাইজেষ্ট দু’টি ছবি দিয়ে ছাপিয়েছে। কৌড়া ডাইজেষ্টের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও বিজেপি’র উদ্দেশ্য যে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ জিইয়ে রেখে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতকে সাম্প্রদায়িক ভারত বানানোর সুক্ষ চেষ্টা তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। এসব অপরাজনীতির ভেতর দিয়ে বিজেপি হয়তো আরো কিছুদিন ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে পারবে কিন্তু আখেরে বহুজাতিক ভারতকে যে বহুখণ্ডে বিভক্ত করে দেয়ার পথে হাটছে সে কি তারা জেনেশুনেই করছে? |