সময়টা ১৯ শতকে যখন টিভিতে ছিলো একটি চ্যালেন বাংলাদেশ টেলিভিশন(বিটিভি), গান শুনতে হতো ক্যাসেট প্লেয়ারে, ফোন করতে হতো ল্যান্ডলাইনে, টেলিভিশনও সকলের ঘরে ছিলো না, বড় বড় দালানকোঠা তখন তেমন তৈরী হতো না, পাকা সড়কও ছিলো না, ছিলো না ইন্টারনেট। তখন সেই একমাত্র চ্যালেন বাংলাদেশ টেলিভিশন(বিটিভি)তে প্রচারিত হতো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’।
এখন ২১ শতকে বদলে গেছে সবকিছু। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। টিভিতে আছে শত শত চ্যানেল, সকলের হাতে রয়েছে স্মার্টফোন, পাকা সড়ক আকাশ ছুঁয়া সব দালানকোঠা কবেই তৈরী হয়েছে, ইন্টারনেট রয়েছে সব জায়গায়, সাদা-কালো বিটিভিও এখন হয়ে উঠেছে রঙিন টিভি, বদলে গেছে তার ধরণ গঠন। শুধু বদলায়নি সেই ১৯ শতকের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ ও তার জনপ্রিয়তা। তিন দশক পরেও আগের মতোই আছে ইত্যাদি। ব্যাঙ্গার্থক শর্টফিল্ম, বিদেশি ভিডিওতে দেশী ডাবিং, প্যারোডি গান, দেশ-বিদেশের নানাধরণের আকর্ষণপূরণ ঘটনা নিয়ে ফিচার এসব অনলাইন যুগের কন্টেন্ট ইত্যাদি দেখিয়েছে দুই যুগ আগে। অতীতেও তার মধ্যে আধুনিকতার ছুঁয়া ছিলো।
১৯৮৯ সালে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল এখনও সাফল্যের সাথে চলমান রয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে আজও ঈদুল ফিতরের পরদিন রাত ১০ টার ইংরেজি সংবাদের পরে সবাই বিটিভিতে চোখ রাখে ইত্যাদি দেখবে বলে। এই একটিমাত্র শো যার কারণে আজও বিটিভি দেখা হয়।
এর প্রধান আকর্ষণীয় দিক হলো সমাজের নানা অসংগতিকে বিদ্রুপ ও রসময় করে উপস্থাপন করা। এর আরো একটি আকর্ষণীয় দিক রয়েছে যেটি দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পায়, সেটি অনুষ্ঠানের নির্মাতা ও উপস্থাপক হানিফ সংকেতের উপস্থাপনা। তার কথা বলার ভঙ্গিমা সকলকে মুগ্ধ করে, এটি ছিলো হানিফ সংকেতের সবচেয়ে বড় প্রতিভা। যার প্রয়োগে তিনি দর্শকদের বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ উপহার দেন।
পেশায় প্রকৌশলী হলে উপস্থাপনা করাটা হানিফ সংকেত পছন্দ করতেন। তার এই ভালোলাগা ও প্রতিভা দর্শকদের দেখানোর সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশের আরো একটি সোনালী পর্দার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করে’। এ অনুষ্ঠানটি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বিটিভিতে প্রচারিত হত। এই অনুষ্ঠানেই নিজের প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি পরিচালনা করার প্রতিভাটুও আয়ত্ব করে নেন হানিফ সংকেত। পরবর্তীতে এই প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ১৯৮৯ সালে নিজ পরিচালনায় ও প্রযোজনায় তৈরী করনে কালজয়ী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’।
সমাজের নানা অসঙ্গতি, সমস্যা, ভালো দিক, অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তির গল্প দুই যুগ ধরে উঠে আসছে অনুষ্ঠানটিতে এখনো আপনি তাই দেখতে পাবেন। নানা-নাতি, মামা-ভাগ্নে, বিদেশী ছবির বাংলা সংলাপ, বিদেশি নাগরিকদের মুখে বাংলা সংলাপে নাটক, নকুল কুমার বিশ্বাসের কন্ঠে অনিয়মের বিরুদ্ধ ভ্যাঙ্গাত্নক গান, সচেতনামূলক বিভিন্ন মাজার নাটক, দর্শক পর্ব ও নিয়মিত শিল্পীদের পরিবেশনা ছিলো ‘ইত্যাদি’র উল্লেখযোগ্য পর্ব।
নানা-নাতি পর্ব ইত্যাদির সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্ব। সেখানে নানা-নাতির টম এন্ড জেরীর মতো তর্কে লড়াই দর্শকদের খুব হাসিয়েছে। এ পর্বে নাতির চরিত্রটি সমাজের প্রচলিত ভুল ধারণা ও ভুল শব্দচয়ন ইত্যাদিকে অবলম্বন নানার ভুল ধরতে থাকে। এতে বিরক্ত হয়ে নানা-নাতির তর্ক শুরু হতো। নানার চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা অমল বোস। তার মৃত্যুর পর নানা-নাতির পর্বটি নানী-নাতি পর্বে পরিবর্তিত হয়। নানীর চরিত্রে অভিনয় করে অভিনেত্রী শবনম পারভীন। নাতির চরিত্রে অভিনয় করেন শওকত আলী তালুকদার নিপু। টানা ২৮ বছর ধরে এ চরিত্রে অভিনয় করছেন তিনি। ‘ইত্যাদি’ ছাড়া অন্য কোথায় কাজ করতে চান না এ অভিনেতা। যত দিন বাঁচবেন নাতি হয় দর্শকদের হাসাতে চান তিনি।
মামা-ভাগ্নের পর্বটি তৎকালীন টেলিভিশন ও সাধারণ জীবন-যাত্রার নেতিবাচক বিষয়গুলোর অবলম্বনে তৈরী করা হয়েছে। এ পর্বে ভাগ্নে একজন ব্যবসায়ীক। ব্যবসার জন্য তিনি নানাধরণের নতুন নতুন ফন্দি খুঁজতেন। কিন্তু এসব ফন্দিতে জনস্বার্থকে হেয় করা হতো। যার কারণে মামা ভাগ্নের ব্যবসায় বাধা সৃষ্টি করতেন। ভাগ্নের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও মামার বাধা সৃষ্টির উপর মাজার গল্পে নাটক তৈরী করা হয়।
বিদেশি ছবির বাংলা সংলাপ এই পর্বটি এখন দেখানো হয় না। পুরনো পর্বগুলোতে এ পর্বটি ছিলো। বিদেশী বিভিন্ন কমেডি সিরিজের দৃশ্যকে বাংলা ভাষায় মজার দৃশ্য তৈরী করা হতো। পর্বগুলোতে কন্ঠ দিতেন হানিফ সংকেত নিজে ও সঙ্গে ছিলো সহশিল্পীবৃন্দ।
বিদেশী নাগরিকদের মুখে বাংলা সংলাপে নাটক ‘ইত্যাদি’ এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব। তাদের মুখে বাংলা ভাষা শুনার জন্য গভীর আগ্রহে থাকে দর্শকগণ। এই নাটকে ভ্যাঙ্গাত্নক রূপে তৈরী না করলেও দর্শক তাতে ভ্যাঙ্গাত্নক খুঁজে নিবে বিদেশি নাগরিকদের মুখে ভুল বাংলা উচ্চারণে ও তাদের কথপোকথন থেকে।
দর্শক পর্ব দেখার জন্য মঞ্চের সামনে উপস্থিত দর্শক ও টিবির পেছনের দর্শকরা অপেক্ষায় থাকে। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে থেকে দর্শক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের কৌশল ব্যবহার করতেন হানিফ সংকেত। তাতে মুগ্ধ হতো দর্শকরা। দর্শকদের হাতে বেলুন দিয়ে তার মধ্যে ব্যতিক্রম বেলুনওয়ালাদের মঞ্চে ডাকতেন। আবার কখনো সবাইকে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ক্ষুদ্রাকৃতি দিয়ে তার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ধরনের বাদ্যযন্ত্রধারীদের মঞ্চে নিতেন। তবে এখন তিনি দেশ, সামাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন করে দর্শক নির্বাচন করেন। নির্বাচিত দর্শকদের মঞ্চে আহ্বান করে বিভিন্ন রকম পরিক্ষার মাধ্যমে বিজয়ী খুঁজে নেন তিনি। পরীক্ষাটা ঠিক এমনি হয় যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতকারদের গান ও বাদ্য বাজিয়ে তার ধরন খুঁজে বের করতে বলা হতো। কখনও কোনো এলাকার ঐতিহ্য নিয়ে গান তৈরর করে গানের মধ্যে থেকে অধিকাংশ সংখ্যক ঐতিহ্যকে মনে রাখতে বলা হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজয়ীদের উপহার দেওয়া হতো সাধারণত কম্পিউটার বা অন্যান্য গৃহস্থালী সামগ্রিক।
হানিফ সংকেত নিজস্ব ক’জন শিল্পী ও ব্র্যাকড্যান্সের মাধ্যমে বিভিন্ন প্যারোডি গান পরিবেশন করেন। এসব গানে বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়, ভুল ধারণা, অসংগতিকে উপস্থাপন করে থাকে।
এই জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের হাত ধরে অনেকেই জনপ্রিয় হয়েছেন বা বলা যায় সেই জনপ্রিয়দের কারণে ‘ইত্যাদি’ জনপ্রিয়। সংগীতশিল্পী মমতাজ, নকুল কুমার বিশ্বাস ও আকবর এই ‘ইত্যাদি’ মঞ্চে পরিচিতি পেয়েছেন। ‘ইত্যাদি’ এদের মাটি থেকে তুলে এনে তারকা বানিয়েছে। ‘ইত্যাদি’র সিঁড়ি বেয়ে তারা তারকা হয়ে উঠে। তাদের সাফল্যে ‘ইত্যাদি’ও সাফল্য পেয়েছে। হাসি, ঠাট্টা-তামাশা ইত্যাদির মাধ্যমে খুব সহজে সমাজের ও ব্যক্তির ভুলগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হয় ‘ইত্যাদি’।
বর্তমানে ‘ইত্যাদি’ তিন মাস পর পর বিটিভিতে সম্প্রচার করা হয়। নতুন ‘ইত্যাদি’ মাসের পঞ্চম শুক্রবার রাত ৮ টার বাংলা সংবাদের পর সম্প্রচার করা হয়। পুরো ‘ইত্যাদি’ প্রতি মাসে প্রথম রবিবার রাত ১০ টার ইংরেজি সংবাদের পর সম্প্রচার করা হয়। প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের পরের দিন রাত ১০ টায় ইংরেজি সংবাদের পরে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়।