হারুনূর রশীদ
সকলের অগোচরে চলে গেলেন প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের আরেক সৈনিক। ইদের আগের দিন গত ৫ জুলাই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাজনীতির উপর খুবই অভিমানি এই রাজনীতিকের শেষ জীবন খুবই নিরলে কাটিয়ে গেছেন। খুবই নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সাথে যোগাযোগ ছিল তার। অথচ তিনিই যুক্তরাজ্যে প্রথম বাকশাল রাজনীতির সূচনা করেন। ১৯৮৩ সালের ২রা আগষ্ট যখন আব্দুর রাজ্জাক ও মহিউদ্দীন আহমদকে আওয়ামীলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় ওই বছরই ২২ অক্টোবর প্রথম বাংলাদেশে বাকশাল গঠন হয়। তার পর থেকেই সি এস কবির ঘনিষ্টভাবে বাকশাল রাজনীতিকে যুক্তরাজ্যে সক্রিয় করে তোলেন।
তিনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ ও আপোষহীন সৈনিক ছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাজনীতিকে তিনি পছন্দ করতেন না। তার মত ছিল, পাকিস্তানকে প্রকাশ্য যুদ্ধে হারিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর, স্বাধীন দেশে পরাজিত পাকিস্তান নমুনার রাজনীতি একমাত্র পাকিস্তানের দোসর ছাড়া অন্য কেউ চিন্তাই করতে পারেনা। বাকশাল রাজনীতি, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের একটি ইতিবাচক দিক বলেই তিনি মনে করতেন। আজীবন নীরবে প্রগতিশীল চেতনাকে লালন করে গেছেন।
স্থানীয় বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি খুবই ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত “নাগরিক মঞ্চ” উল্লেখযোগ্য। দূর্ণীতিকে কখনও মনে প্রশ্রয় দেননি। উল্টো দূর্ণীতির বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত ছিলেন এই অকুতভয় মুক্তিসৈনিক। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূর্ণীতির সাথে হাত মেলানোর বিপক্ষে তিনি সবসময় মত রেখে গেছেন।
মাঝে মধ্যে তার সাথে আলাপ হতো। খুব ঘনিষ্ট হয়ে কথা বলতেন। আমাদের এলাকার সম্পর্কে তাকে আমি চাচা বলে সম্ভোধন করতাম। তার বড়ভাই মরহুম হুমাইউন কবির চৌধুরী আর আমার আব্বা ভাই ভাই সম্পর্ক ছিল। আমার বাবাকে হুমাইকবির সাহেব ”ভাইসাব” বলে ডাকতেন।
সিএস কবির, কখনও আমাকে তুমি বলতেন আবার কখনও আপনি বলে সম্ভোধন করতেন। তার কথা থেকেই বুঝতে পারতাম, চলমান রাজনীতির উপর তিনি খুব আস্তাশীল ছিলেন না। একদিন আলাপ প্রসঙ্গে বললেন দেখুন, আমার কাছে একটা অতি ক্ষুদ্র বাতি আছে, টিম টিম করে জ্বলছে। মানুষ পাইনা কাকে দিয়ে যাবো! সঠিক মানুষকে যদি দিতে না পারি তা’হলে অবশ্যই এ বাতি দীর্ঘদিন জ্বলবে না। যে কোন দমকা হাওয়ায় নিভিয়ে দিবে একদিন।
তিনি খুব ভাল লিখিয়ে ছিলেন। সত্যিকার অর্থেই ক্ষুরধার লেখনির অধিকারী ছিলেন। কিন্তু কেনো জানি লিখা-লিখিতে খুব মন ছিল না। মাঝেমধ্যে এখানকার বাংলা পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা লিখতেন। আমি পড়তাম। খুব ভাল লাগতো। টেলিফোন করে তাকে উৎসাহ দিতাম। তিনি হাসতেন। কিছুই বলতেন না। উল্টো আমাকে বলতেন- তুমি লিখনা কেনো? তুমিতো পেশাদার সাংবাদিক ছিলে। তোমার নিজের পত্রিকা আছে, তবুও তোমাকে লিখতে দেখি কম। এভাবেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন। তার একটি বইও আছে। লিখেছেন তার জীবনের অভিজ্ঞতা। কি দেখেছেন আর কি পেয়েছেন।
আমার জানা ও দেখা মতে রাজনীতির পাশাপাশি সেবা কর্মের দিকে তিনি খুবই মনেযোগী ছিলেন। “নাগরীক মঞ্চ” নামক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই নাগরীক মঞ্চ প্রতিষ্ঠালগ্নে তার সান্নিধ্য পাওয়ার। ওই সময় তিনি লন্ডনের হলবর্ণ এলাকায় বেশ দামী একটি ফ্লাটে থাকতেন। বহু পরে তিনি অন্যত্র সরে গিয়ে ঘর বাধেন। হলবর্ণ এলাকায় থাকতে প্রায়ই তার ঘরে “নাগরীক মঞ্চ”এর সভা বসতো। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তার হলবর্ণের ফ্লাট বাড়ীই ছিল দপ্তরখানা। ওখান থেকেই নাগরীক মঞ্চের সকল কাজ-কর্ম পরিচালিত হতো। তার ওই ঘরে সভা করতে বহু গিয়েছি। ওই সূত্রেই তার ওখানে ঘন ঘন যাওয়া আসা করতে হতো। তখনই দেখার সুযোগ হয়েছিল তার সাধনা, নিষ্ঠা আর দৃঢ়তার কঠোরতা। তার ঘরেই বহু প্রতিথযশা ব্যক্তিত্বের সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়। তার ওখানেই পরিচিত হই বেরিস্টার ইসহাক, শিক্ষক মনির হোসেন, ধীমান রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী এনামুল হক প্রমূখ ব্যক্তিত্বের সাথে। বেরিস্টার ইসহাক ইহলোকে আর নেই। প্রচার বিমুখ শিক্ষক মনির হোসেন ও এনামুল হক সাহেব জীবিত আছেন। কিন্তু খুবই নীরবে নিভৃতে জীবন কাটাচ্ছেন।
একদিন তার লন্ডনের ফ্লাট বাড়ীতে জানতে চেয়েছিলাম কেনো তিনি লিখা-লিখিতে মনযোগী নন। উত্তরে বলেছিলেন যে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বাংলা লিখা দিয়ে অন্ততঃ তার দ্বারা জীবন চালানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয় তার পারিবারিক অবস্থা। তার একমাত্র ছেলে আজীবনের অসুস্থ্য। তাকেই দেখাশুনা করতে হয়। এই একটি দিক থেকে তিনি খুব অসুখি ছিলেন।
সি এস কবির প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করতেন প্রগতিশীল রাজনীতিতে। বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতেন। তার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে আরো তিনজন ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও মাওলানা ভাসানী। খুবই সাদা মনের মানুষ ছিলেন রাজনীতিক এই সি এস কবির। মৌলভীবাজারের আখাইলকুড়া ইউনিয়নের খা’র গায়ে তার জন্ম হয়েছিল। ছিলেন কঠোর পরিশ্রমি। ছিলেন নিঃশঙ্ক চিত্ত।