‘অপেরা নিউজ’ নামের এক ফেইচবুকে ইজুয়েজিওগু নামের একজন প্রায় দু’বছর আগে বর্তমান মুখোশ ব্যবহারের বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন- “মনে হয় আমাদের পূর্বসূরিদের অতৃপ্ত অত্যাচারিত আত্মাই করোনা হয়ে এসেছে প্রতিশোধ নিতে। তাই এখন সকলকেই মুখোশ পড়ে চলতে হয়।”
তার সে লেখার মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের পরিচিত বিশ্বের অতীতের দাস প্রথা। তার কথাকে অনুসরণ করে অন্তর্জাল খুঁজে দাস ও মুখোশ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে পাওয়া গেল যে পশ্চিমা ধনিক-বণিকগুষ্ঠী ইউরোপ ও আমেরিকায় দাস সরবরাহের ব্যবসা করে দুনিয়া ঘুরতো। আর দাস মালিকেরা এসকল দাস-দাসী কিনে নিয়ে তাদের পছন্দমত কাজে লাগাতো। বড় ধনী ছোট ধনী সকলেই সুন্দরী দাসীদের যৌনকাজে ব্যবহার করতো। সে সময়ের নিয়ম নীতি অনুযায়ী দাসীরা মালিকের ইচ্ছেমত কাজ করতে বাধ্য ছিল। অন্যান্য দাস-দাসীদের দিয়ে ঘরের ভেতরের কাজ বাইরের কাজ সবকিছুই করানো হতো।
পায়ে লোহার শেকল, মুখে পড়া লোহার মুখোশ, মাথায় পানির বাসন নিয়ে যাচ্ছে একজন দাস। ছবিঃ অন্তর্জাল |
রোমের একটি মুক্ত বাজারে বিক্রির জন্য দাস-দাসী নিয়ে দাসমালিক। ছবিঃ অন্তর্জাল |
যাদেরকে দিয়ে ঘরে ফসল তোলার কাজ করানো হতো বিশেষ করে ফলের বাগান থেকে ফল পাড়ার কাজ করানো হতো তাদের মুখে লোহার তৈরী মুখোশ লাগিয়ে সে মুখোশে তালা মেরে রাখা হতো। কারণ, কাজের ওই দাস বা দাসী যা’তে ফল তুলার কাজের ফাঁকে ফল নিজে না খেতে পারে। অনেক সময় মুখে একটি ফল গোঁজে দিয়ে মুখোশে তালা মেরে রাখা হতো ।
মাঝে মাঝে দাসেরা তাদের দেশীয় ধর্মীয় জীবনমুক্তির গান করতো। যেসব গান মালিকদের একেবারেই ভাল ঠেকতো না। তাই ফল না খাওয়া এবং গান করতে না পারা এ দু’টি অবস্থাকে কাজে লাগাতে দাসদের লোহার মুখোশ পড়িয়ে দেয়া হতো। আর একটি বিষয় দাসমালিকদের নজর এড়াতো না। আর সেটি হলো এই দাসেরা যেনো তাদের সন্তান সন্ততিদের তাদের নিজ ভাষা শিখাতে না পারে বরং মালিকদের নিজেদের ভাষা যাতে শিখে নেয় সেদিকেই নজর রাখা হতো। আর সে কারণেও মুখে লোহার মুখোশ পরিয়ে রাখা হতো। যা’তে স্পষ্টভাবে কথা বলতে না পারে।
ইজুয়েজিওগু তার লিখার শেষে লিখেছেন, এ রকম মুখে ফল পুরে দিয়ে লোহার মুখোশে তালা মেরে ঘন্টার পর ঘন্টা রাখা যে কি অমানুষিক আর অমানবিক নির্যাতন যা কালের পর কাল সহ্য করতে হয়েছে আমাদের পূর্বসুরীদের। এ ছিল হাজারো রকমের অমানুষিক শাস্তির মাত্র একটি। ঘৃণ্য এ সকল জবর দখলদাররাই আমাদের দিয়েছিল খৃষ্টধর্ম এবং মানসিক দাসত্বের ধর্ম। এরাই আফ্রিকানদের উপর নির্দয় পশুর মত কূটচালে ভাগাভাগি চাপিয়ে দিয়েছিল।
ইজুয়েজিওগু-এর কাহিনী এখানেই শেষ হলেও এটি বলতে কোন দ্বিধা নেই যে সেই মুখোশ পড়া এখন বিশ্বব্যাপী অবশ্য পালনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে নতুন করে পুরো ভিন্ন আঙ্গিকে। সারা বিশ্বজুড়ে করোণা মহামারীর অপ্রতিরোধ্য হত্যাযজ্ঞের প্রাথমিক প্রতিষেধক হয়ে উঠেছে এই ‘মাস্ক’ বা মুখোশ। অথচ কে-ই না জানে যে প্রায় দুই শতাব্দী আগেও মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধণিক-বণিকেরা আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে নিয়ে আসতো পুরো পুরি বন্য পশুর মত করে হাতে-পায়ে লোহার শিকল পড়িয়ে মুখে লোহার মুখোশ পড়িয়ে। এদের দিয়ে পশুর পরিশ্রম করিয়ে নিতো নিজেদের আরাম-আয়েশ ও ব্যবসার মুনাফার জন্য। এই আরবীয়ান, ইংরেজ, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসী, স্পানীশ, আর ফিনিশীয়রা এ পৃথিবীতে মূলতঃ শুরু করেছিল দাস-দাসী বেচা-কেনার ব্যবসা। আমাদের এই ভূ-ভারতেও খুব দাপটেই এই দাসপ্রথা কাজ করেছে সকল নৈতিকতা মানবিকতাকে অবলিলায় বিসর্জন দিয়ে।
উইকিপিডিয়া, ডেভিড ফোর্সথি’র উদৃতি দিয়ে লিখেছে, “ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে আনুমানিক প্রায় তিন চতুর্থাংশ লোকেরাই দাসপ্রথার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। ইউরোপীয় দাস বেপারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ১৪১৬ সালে রাগুসা(হংকং) নামক দেশ দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেছিল। হংকং এর প্রাচীন নাম ছিল ‘রাগুসা’। আধুনিক যুগে নরওয়ে এবং ডেনমার্ক সর্বপ্রথম ১৮০২ সালে দাসদের বাণিজ্য বন্ধ করে। এরও বহু বহু আগে আরবীয়ানরা ঘোষণা দিয়ে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেছিল।
ইংরেজ শাসকরা ভারতে ১৮৩৩ সালের ‘চার্টার অ্যাক্ট’ দ্বারা যথাসম্ভব দ্রুত সব ধরনের দাস প্রথা অবলুপ্ত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে কলকাতার সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল। ধাপে ধাপে দাস প্রথার অবলুপ্তির জন্য ১৮৪৩ এর ‘অ্যাক্ট ফাইভ’ প্রণীত হয়। এ আইনের আওতায় দাস রাখা অপরাধমূলক ছিল না, এতে কেবল মুক্ত ব্যক্তি ও দাসের মধ্যে আইনগত পার্থক্যের অবসান ঘটানো হয়েছিল। আইনে বিধান রাখা হলো যে, কোনো আদালত কোনো দাসের ওপর কারও দাবি গ্রাহ্য করবে না। এ আইন কিন্তু সব দাসদের মুক্ত বলে ঘোষণা করে নি। বরং আইনে বলা হলো যে, কোনো দাস ইচ্ছে করলে তার মালিককে পরিত্যাগ করে স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে।