মেধাবী, জ্ঞানীগুণীমানুষগুলো কেনো জানি দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়। ছাত্র-শিক্ষক, গুরু-শিষ্য, শিল্পী-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে মৌলভী-মোল্লা-মুন্সী, হাজিসাব, কাজীসাব, গাজীসাব, দেওয়ানসাব, চৌধুরীসাব, খানসাব সকলেই বিদেশ যেতে পাগলপারা। যে কোন একটা সুযোগ পেলেই হলো। দেশে থাকতে চায় না।
আর সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরতো কথাই নেই। সরকারী খরচে তাদের বিদেশ ভ্রমণের অবাধ সুযোগ থাকার পরও দেশ ছেড়ে বলতে গেলে অনেকটা পালাতেই চায়। কারণ তারাই ভাল জানে।দেশের ভাল আয় রোজকারী জনপ্রিয় শিল্পীগন দেশে থাকতে চায় না। দীর্ঘদিন কাজ করে অর্থ-কড়ি হলে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সুযোগ পেলেই দেশ ছেড়ে চলে যায়। অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে আর ফিরে না, ফিরতে চায়ও না। দেশের অধিকাংশ কারিগর দেশে থাকে না, থাকতে চায় না। এ রীতিমত গবেষণার বিষয় বলে আমি মনে করি।
আমাদের অনেকেরই জানামতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সরকারি আমলা—প্রতিটা পেশাজীবী মানুষ বিদেশ গেলে ফিরে আসতে চায় না। পরিচিত বহু পেশাজীবী মানুষদের একটাই কথা—সুযোগ পেলেই দেশ ছাড়বে। কেউ বলে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য। কেউ বলে শেষ বয়সে একটু শান্তির জন্য। কেউ বলে পরিবার-পরিজনের জন্য। কেউ বলে যোগ্যতার সুবিচার পাওয়ার জন্য। কেউ বলে উচ্চশিক্ষার জন্য। কেউ বলে ধর্মীয় রোষানল থেকে মুক্তির জন্য। কেউবা বলে দেশে নিরাপত্তা নেই। দেশে থাকতে ভয় করে। রাজনৈতিক দুর্যোগের ভয়, সময়ে সময়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হরেক রকম ‘যুদ্ধের’ শিকার হওয়ার ভয়, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীর ভয়, হাজার হাজার ‘বিরোধীদলীয়’ তরুণের কারাগারে যাওয়ার ভয়। মামলা-হামলার ভয়ে অনেকেই পগাড়পার, অর্থাৎ দেশান্তরি। আমাদের পরিচিত বহু নেতা-নেত্রীর সন্তানেরা বিদেশী নাগরীক হয়ে দেশ ছেড়েছে এমন প্রমাণ ভুরি ভুরি। আর দেশের অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে গিয়ে বাড়ী-গাড়ী করে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছেন এতো সকলেরই জানা।
আবার জঙ্গিবাদের ফাঁদের ভয়েও ছেলেমেয়েকে দেশে রাখতে চান না অনেকে। সবাই এসবে আক্রান্ত হচ্ছেন বা হবেন তা না, কিন্তু লাখে একজনও যদি এমন মর্মান্তিক বা করুণ পরিণতিতে পড়েন, তা দেখে অন্যরা ভয় পেয়ে যান। কারণ আইনের শাসনের আশ্বাসটুকুও নেই। দেশে আবার চাকরির সুবিধাও নেই। অনেকেই বেকারত্ব জীবন কাটান। মানসিক চাপে সহ্যহীন থাকেন।
আপনি যদি আপনার চারপাশের মানুষদের নিয়েই একটা জরিপ করেন, দেখবেন আশি শতাংশ মানুষ সুযোগ পেলে দেশ ছাড়তে চাইবে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, বায়ান্ন বছরে আমরা কেমন সমাজ তৈরি করলাম—যেখান থেকে সবাই পালাতে চায়! মানুষের ভিতর একটা উর্ধ্বশ্বাস! একটা দীর্ঘশ্বাস। পালিয়ে বেড়ানোর এক নিরন্তর চেষ্টা।
তার কারণ কী? তার জন্য সরকার দায়ী না আমরা নিজেরাও দায়ী। আমার মতে আমরাই দায়ী। এই যেমন ধরো আমরা বলি দেশে চাকরির সুযোগ নাই। দেশে চাকরির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি দেখানো হয়। তা বটে সঠিক সুযোগ্যরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পায় না। কিন্তু সব থেকে বড় কথা হলো আমরা কর্মের মূল্যায়ন করতে জানি না। এই যেমন কোন ব্যক্তি যদি তার যোগ্যতানুযায়ী চাকরি না পায়। তাহলে সে অন্য কিছু করে তার জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। কিন্তু সে অন্য কিছু করতে চায় না। সে ভাবে ঐ কাজ তার জন্য নয়। সে যদি ঐ কাজ করে তবে লোকজন সমালোচনা করবে। বলবে অমুকের ছেলে তমুকের ছেলে এই কাজ করছে। তাতে সে লজ্জিত বোধ করবে। তাই সে ভাবে এই কাজ করার চেয়ে বেকার থাকা ভালো। কিন্তু সেই ছেলে বিদেশে গেলে ঠিক এই কাজটিই করে, তখন সে লজ্জিত বোধ করে না। কারণ সেখানে যেকোনো কাজের মূল্যায়ন করা হয়। কারো কাজ নিয়ে সমালোচনা কারা হয় না, কাউকে ছোটো করে দেখে না। তাই মানুষ সেখানে গিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
আর দেশের এমন পরিস্থিতি আমরাই সৃষ্টি করেছি। আর আমরাই এই পরিস্থিতির মোকাবেলা না করে দেশ থেকে পালাতে চাই। আর ওপারে গিয়ে নিজের দেশেরই সমালোচনা করি। আর বিনা টাকায় উপদেশ দিতে থাকি। আমাদের উচিত নিজের দেশটাকে নিজের করে বুঝে নিয়ে নিজেদের জন্য নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় করা। দেশ গড়ার দ্বায়িত্ব আমাদেরই।