লন্ডনে হয়ে গেলো বাউল শাহ আব্দুল করিম লোক উৎসব ২০২৪
“কিংবদন্তি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম লোক উৎসব ২০২৪” সফলতার সাথে সম্পন্ন হয়ে গেলো লন্ডনে। গনতন্ত্রের সূতিকাগার নামে খ্যাত বহুজাতিক ও বহুসাংস্কৃতিক বৃটিশ সমাজের নানা শ্রেণি পেশার বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় ও আনন্দঘন পরিবেশে জাঁকজমক পুর্ণভাবে অর্ধ শতাধিক সুনামধন্য শিল্পীদের অংশ গ্রহণে “বাউল শাহ আব্দুল করিম লোক উৎসব ২০২৪” সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশীদের মমতা মেশানো উদাস প্রাণে উত্থাল ঢেউ জাগানো জাতীয় সংগীত- “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…”এর নান্দনিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ভাব-গম্ভীর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে এ উৎসব।
লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে এই প্রথমবারের মতো আরিয়ান ফিল্ম এবং গ্লোব টিভি আয়োজিত উৎসব আয়োজন সঞ্চালনা করেন ইউকে বিডি টিভির সাংস্কৃতিক পরিচালক ও উৎসব কমিটির সম্পাদক হেলেন ইসলাম, সুপ্রভা সিদ্দিকী, হাফসা ইসলাম, শেখ নুরুল ইসলাম এবং মতিউর রহমান তাজ। ব্রিটেনের দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিশিষ্টজন ও প্রচুর বাউলসংগীত ভক্ত ও বিপুল সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে গত ৯ই অক্টোবর দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে বহুমুখী এ উৎসবের অনুষ্ঠানমালা।
সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারের দুটি মঞ্চে একযোগে পুরো দিন ব্যাপী চলে প্রাণবন্ত এ উৎসবমুখর কর্মসূচী। অর্ধ শতাধিক সুনামধন্য শিল্পীগন পরিবেশন করেন বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান, জারি, সারি, ভাটিয়ালী। এর পাশাপাশি আরও ছিলো বাউল শাহ আব্দুল করিমের জীবনী নিয়ে প্রমাণ্য চিত্র প্রদর্শনী। উৎসব প্রাঙ্গনেই বসেছিলো বিভিন্ন ধরনের খাবারের স্টল, পিঠা, কাপড়, মনিমুক্তাখচিত অলংকার, মেহেদী, ফটো ফ্রেম সহ রকমারি দোকান আর ছিল দেখারমত গ্রাহকের উপচে পড়া ভিড়।
অনুষ্ঠানে লোক উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে লন্ডনের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও কমিউনিটিতে বিশেষ অবদানের জন্য ৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। তারা হলেন আনোয়ার চৌধুরী, আহবাব হোসেন, আলাউর রহমান, শেখ আলীউর রহমান, সিরাজ হক, জ্যোৎস্না ইসলাম, আকলু মিয়া, মাহি ফেরদৌস জলিল ও তাজরুল ইসলাম তাজ।
প্রাণবন্ত উৎসবমুখর এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেক বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, বৃটেনের নিউহ্যাম কাউন্সিলের চেয়ার রহিমা রহমান, লন্ডন বরো অফ বার্কিং এন্ড ডেগেনহ্যাম কাউন্সিলের মেয়র কাউন্সিলার মঈন কাদরি, টাওয়ার হ্যামলেটস এর সাবেক স্পীকার আহবাব হোসেন, প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক অকাউন্টেন্ট মাহমুদ এ রউফ, কমিউনিটি লিডার সিরাজ হক, রেডব্রিজ কাউন্সিলের সাবেক মেয়র জ্যোৎস্না ইসলাম, চ্যানেল এস এর ফাউন্ডার্স চেয়ারম্যান মাহি ফেরদৌস জলিল, গ্রেটার সিলেট কমিউনিটি ইউকের কেন্দ্রীয় কনভেনার বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ মকিস মনসুর, কবি মুজিবুল হক মনি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আখলু মিয়া, কাউন্সিলার সাম ইসলাম, কাউন্সিলার ফয়জুর রহমান চৌধুরী, কাউন্সিলার মুজিবুর রহমান জসিম ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরাম ইউকের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ শাফি কাদির।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা বলেন প্রয়াত আব্দুল করিম ছিলেন একজন জাত বাউল, দার্শনিক, পর্যটক এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তিনি সবসময় সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের পক্ষেই ছিল তার জীবনকর্ম। গানের মাধ্যমে সাম্য, মানুষের মুক্তি ও প্রেমের জয়গান গেয়েছেন তিনি। তিনি জাত-পাত, শ্রেণি-বিদ্বেষ ভুলে মানুষকে সবসময় অসাম্প্রদায়িক জীবন-যাপনের পথে টেনেছেন।
উল্লেখ প্রয়োজন যে, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা বাউল গানের জীবন্ত কিংবদন্তী সুর সহ সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। শাহ আব্দুল করিম শহুরে মানুষের কাছে যতটা আগে পরিচিত হয়েছেন তার অনেক পূর্বে গ্রামের মানুষের কছে জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছিলেন। জারি, সারি, ভাটিয়ালী, জীবন তত্ব, প্রেম, বিচ্ছেদ, জাগরনের গান ও দেশের গান সহ প্রায় ১৫০০ গানের এ রচয়িতা ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
অত্যান্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করেন বাউল গানের জীবন্ত এ কিংবদন্তী। দারিদ্রতা পরিবারকে এমনভাবে আকড়ে ধরে রেখেছিল যে প্রতিবেলার খাবার যোগান দিতেও তার বাবার কষ্ট হত। জীবনে মাত্র ২ বার বিদ্যালয়ে পা দিয়েছিলেন এ বাউল সাধক। পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় তার উপর চাপটা বেশি ছিল। এজন্য তিনি চাকরিতে যোগ দেন। কষ্টে আকড়ে ধরা জীবনে তিনি ঈদের দিনেও ছুটি পেতেন না। দারিদ্র ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। গান গাওয়ার শুরুতেই তাকে ধর্মীয় বিধি নিষেদের দায় গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়।
বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বাউল সম্রাটের প্রেরণা তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। তিনি তাকে আদর করে সরলা বলেও ডাকতেন। বেশ কয়েকটি গান তিনি সরলার নাম দিয়ে লিখেছেন ও গেয়েছেন। যদিও দারিদ্র তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যয় করতে কিন্তু কোন কিছু তাকে সুর ও গীত সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
জানা যায়, বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। বাউল শাহ আবদুল করিমের এ পর্যন্ত ৬টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো- আফতাব সংগীত, গণ সংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে এবং দোলমেলা। এছাড়াও তাঁর রচনাসমগ্র ‘অমনিবাস’ সম্প্রতি বাজারে এসেছে।
বাউল শাহ আব্দুল করিম ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তার দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। এছাড়া দ্বিতীয় সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে এই বাউল সম্রাটকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সালে কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক ও পেয়েছিলেন এই বাউল সম্রাট।