হারুনূর রশীদ।।
ভুল কি শুদ্ধ জানিনা তবে ‘ফেইচবুক’ দেখা এখন স্বভাবে পরিণত হয়েছে। সপ্তাহে দু’একদিন বিশেষ কোন কারণে হয়তো বাদ যায় আর না হলে পুরো সপ্তাহ একবার না একবার ‘ফেইচবুক’ দেখতেই হয়। শুধু যে দেখার জন্য দেখা তা’নয়। বহু সুপরিচিত, পরিচিত ছোটবড় অনেককেই দেখতে পাই। অনেকের সাথে আলাপও হয়। অনেকে আবার তাদের দৈনন্দিন কর্ম প্রবাহের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। কোথায় গেলেন কিংবা যাচ্ছেন, কি করছেন, কোন দেশ ঘুরছেন, শেষমেষ কোন বইটি লিখা শেষ হয়েছে, কোন পদোন্নতি হয়েছে কি-না; জীবনের কত রংবেরংএর কাহিনী দেখি। উন্নত আর অনুন্নত উভয় বিশ্বের খবর প্রতি সেকেন্ডে ‘ফেইচবুক’ দিচ্ছে। সবগুলোই যে সত্য খবর তা হয়তো নয়। সত্য খবরটি একটু খুঁজে নিতে হয়। কিন্তু খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতি মূহুর্তের। রেডিও টিভির আগেই আচমকা আচমকা খবরগুলো বুর বুর করে ‘ফেইচবুক’ ফাঁস করে দিচ্ছে। বিবিসি, সিএনএন কিংবা আরটি-এর মত সংবাদ মাধ্যমগুলোর সংবাদ প্রচারের ধরনই পাল্টে দিয়েছে এই ‘ফেইচবুক’। দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার কোন দেশে পুলিশ কিভাবে ঘোষ নিল, ডাক্তার কি করে রোগীনিকে ধর্ষণ করলো, পুলিশের সাথেই অবৈধ পিস্তল হাতে রাজনৈতিক ক্যাডারের অস্ত্র প্রদর্শন, কিংবা কেনো হিলারী ক্লিন্টন পাশ করতে পারলেন না, সিরিয়া যুদ্ধের সাথে তার কি সংযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি রকমারি সব জবরদস্ত খবর পাবেন ‘ফেইচবুক’-এ। কমপক্ষে একদিন পর দেখবেন বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলো সেই একই খবর দিচ্ছে। দুনিয়ার এমন কোন সংবাদ মাধ্যম নেই যাদের ‘ফেইচবুক’ নাই। ফলে, ইদানিং ‘ফেইচবুক’ দুনিয়ার তাবৎ বাঘা বাঘা সংবাদ মাধ্যমকে ডিঙ্গিয়ে নিজেই এককভাবে সংবাদ জগতের একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে উঠেছে।
আমার খুব ভাল লাগে। তাই পরিচিতজনদের প্রায় সকলেরই ফেইচবুক আমি দেখি। আমাকে খুব আনন্দ দেয়। ভাবি বিজ্ঞানের কি অবদান! সুমধুর ভাষা নেই আমার, এ উপলব্দিকে ভাষা দিয়ে সরস সুখপাঠ্য করে তোলার। যে কয়েকটি ফেইচবুক প্রায়ই দেখি তার মধ্যে একটি, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় কূটনীতিক নয়াদিল্লীতে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সাহেব। বহু সুনামধন্য সংবাদপত্রের পাতা থেকেও এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাইনা যা তার ফেইচবুকে খুবই স্বচ্ছ সুন্দর সংক্ষিপ্ত ভাষায় তুলে ধরা হয়। অযথা বাড়িয়ে বলছি না, বাংলাদেশের অন্য কোন সরকারী দফতর, মনে হয় না দেশের তথ্য অধিকার আইনের এমন স্বচ্ছ সফল প্রয়োগ করেন বলে। আমি নিজে আমারই পরিচালিত ও সম্পাদিত একটি অনলাইনে কাজ করি। আর এ কাজের কারণে ‘ফেইচবুক’ খুঁজে খুঁজে দেখি কখন কোথায় কি ঘটছে। গতকাল মান্যবর মোয়াজ্জেম ভাইয়ের ফেইচবুক দেখতে গিয়ে পেয়ে গেলাম সে রকমই একটি বিষয়। শিল্পী শ্যামল মিত্রের ছোট্ট জীবন কাহিনী। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের দু’টি লাইনের কথা আমার আবেগে একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি দিয়ে গেল উপলব্দি করলাম। তিনি লিখলেন-“My homage to maestro Shymal Mitra: who mesmerized us in our youth. He died on this day nearly four decades ago and yet his sweet melodious voice continue to sooth our nerves. A pillar of the golden era of Bengali modern songs”.। পড়ে, অল্প কিছুক্ষনের জন্য খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মন চলে গেল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলিতে। শ্যামল মিত্রের সুকন্ঠের সেই মধুর ধ্বনি আমার কানে যেনো ঝঙ্কৃত হয়ে উঠছিল ক্ষনে ক্ষনে- “আমার স্বপ্নে দেখা রাজকণ্যা থাকে, সাত সাগর আর তেরো নদী পাড়ে…”। “কার মন্দিরে বাজে রিনি ঝিনি ঝিনি…”। কি কারণে জানিনা মনটা একটু উৎফুল্ল বিমোহিত মনে হল! ঠিকই তো, শ্যামলমিত্র আমাদের কৈশোরের শেষ আর যৌবনের প্রারম্ভিক সময়ের প্রখ্যাত আধুনিক সংগীতের শিল্পী। তার সেই সুরেলা কন্ঠ স্বর ও সুর এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা যতই বাগাড়ম্বর করিনা কেনো সেই মিষ্ট সুরেলা কন্ঠ উভয় বাংলায়ই আর গড়ে উঠেনি। শুধু কি তাই সেই অমিয় বাণীসম কথাও আজকাল কেউ লিখেনা। লিখেনা কথাটা মনে হয় সঠিক নয়। আসলে সে ধরনের মেধা ধীদীপ্ত সঙ্গিতকার গড়েই উঠেনি। কোনটা ছাড়বো আর কোনটা বলবো। শ্যামল মিত্রের অন্ততঃ ৫০টিরও মত গান আছে যার কোন বিকল্প আজও শুনিনি। তার সেই “চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কি হবে…?”, কি জীবনধর্মী কথা। আর সুর! সেতো পাগল করা ছিল আমাদের যৌবনের সূচনায়!
বাংলার সেই কোকিল কন্ঠ প্রয়াত হয়েছেন ১৯৮৭ সালের ১৫ই নভেম্বর। গত কাল ছিল তার ২৯তম মৃত্যু বার্ষিকী। তাকে নিয়ে লিখক রক্তিম সেন খুব আন্তরিক হয়ে লিখেছেন-“তিনি তখন কলেজে। গান করেন টেবিল বাজিয়ে। মাঝে মাঝে দু’-একটা ফাংশন। তেমনই কোনও এক আসরে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় লক্ষ করেন তাঁকে। সতীনাথ তখন থাকতেন চুঁচুড়াতেই। সতীনাথ পরামর্শ দিলেন, কলকাতায় যেতে হবে। গানের আলোয় আসতে গেলে সে ছাড়া গতি নেই। সুধীরলাল চক্রবর্তীর নামটাও সতীনাথই করেন। তার পরেই শ্যামল মিত্র সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে কলকাতায় গানের তালিম নিতে থাকেন।”
তিনি আরও লিখেছেন শ্যামল মিত্রের “জন্ম – নৈহাটি । পিতা – ডঃ সাধন কুমার মিত্র । স্ত্রী – প্রতিমা মিত্র । সন্তান – মনবীণা , শৈবাল মিত্র , সৈকত মিত্র। প্রায় পঞ্চাশটির মত ছবিতে শ্যামল মিত্র সুর দিয়েছিলেন এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। শুরুটা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে, ‘লাখ টাকা’ ছবিতে। এ ছবিতে শ্যামল মিত্রের সঙ্গে যৌথভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন নীরেন লাহিড়ী। এ ছবিতে গান ছিল চারটি, ‘আলো যে জেগেছে চাঁদে’, ‘বলো প্রিয়তম বলো’, ‘অর্থের অর্থ অনর্থ ভাইরে’ এবং ‘সান্ত্বনা নাহি মানে মন’। এ ভাবেই একের পরে এক ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘ডেলি প্যাসেঞ্জার’, ‘ভ্রান্তি’, ‘সখের চোর’, ‘হাসি শুধু হাসি নয়’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘সপ্তর্ষি’, ‘তৃষ্ণা’, ‘রাজকন্যা’, ‘খেয়া’, ‘হঠাৎ দেখা’, ‘গড় নাসিমপুর’, ‘বিবাহবিভ্রাট’, ‘দুরন্ত চড়াই’, ‘সমান্তরাল’, ‘পদ্মগোলাপ’, ‘প্রতিবাদ’, ‘জননী’, ‘জীবন জিজ্ঞাসা’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘অন্ধ অতীত’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘চিঠি’, ‘অমানুষ’, ‘ফুল ঠাকুরমা’, ‘আমি সে ও সখা’, ‘রাজবংশ’, ‘অজস্র ধন্যবাদ’, ‘জাল সন্ন্যাসী’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘বন্দী’, ‘নিশান’, ‘ধনরাজ তামাং’, ‘প্রিয়তমা’, ‘খনা বরাহ’, ‘বন্দীবলাকা’, ‘কলঙ্কিনী’, ‘মায়ের আশীর্বাদ’, ‘মাটির স্বর্গ’, ‘সংসারের ইতিকথা’, ‘কেনারাম বেচারাম’, ‘মহামিলন’, ‘একাকী’…। এই ৪৬টি ছবিতে শ্যামল মিত্রের সুরে প্রায় দেড়শো গান আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সুরকারের সুরে নানা ছায়াছবিতে শ্যামল মিত্র বহু গান গেয়েছেন। তেমন ছায়াছবির সংখ্যা প্রায় ১০০। গড়ে একটি করে গান ধরলেও অন্য সুরকারের সুরে শ্যামল মিত্রের গাওয়া গানের সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১০০। সুতরাং শুধু ছায়াছবির গান হিসেব করলেই শ্যামল মিত্রের গাওয়া গানের সংখ্যা ১৫০-র মতো। অথচ তার মাত্র গোটা পঞ্চাশেক এখন বহু কষ্টে শ্রুতিসুলভ। বেসিক রেকর্ডে শ্যামল মিত্র গেয়েছেন দেড়শোরও বেশি আধুনিক গান। তার গীতিকার-সুরকারের তালিকায় পবিত্র মিত্র, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্রীশঙ্কর, শ্যামল গুপ্ত, সুধীন দাশগুপ্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হিমাংশু দত্ত, সলিল চৌধুরী, সুবীর হাজরা, শৈলেন রায়, পঙ্কজ মল্লিক, মোহিনী চৌধুরী, নিতাই ঘটক, দুর্গা সেন বিখ্যাত, স্বল্পখ্যাত নামগুলি এ রকমই।”
যুদ্ধবাজ, মৌলবাদী ভন্ড ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পাকি আমল আমাদের সংস্কৃতি চর্চ্চাকেও দুইভাগ করে রাখার চেষ্টা করেছিল তাদের পুরো ২৪ বছর সময়কাল। সেই যে অশুভ বৃক্ষ রোপন হয়েছিল আমাদের মাটিতে আজ তা ডাল-পালা দিয়ে বহুবিস্তৃত জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। আমাদের কয়েক পুরুষের মনোজগতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে দ্বিজাতি তত্ত্বের বীষময় বীজ। বিগত ৪৫ বছরেও আমরা পারিনি সেই বিষাক্ত বিকারগ্রস্ত মনকে দোষণমুক্ত করতে। তাইতো দেখি চট্টগ্রামে বৌদ্ধ পাড়ায় আগুন। নাসির নগরে হিন্দু বস্তিতে আগুনের সাথে হত্যালীলা। শ্যামল মিত্র এখানে স্থান পাবেন কি করে? এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ কূপ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
বুধবার, ৩০শে কার্তিক ১৪২৩
১৬ নভেম্বর ২০১৬