আব্দুল ওয়াদুদ, মৌলভীবাজার।। আজ ১১ই জুন। উপমহাদেশ খ্যাত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী লীলানাগের মৃত্যু দিবস। নারী স্বাধীনতা স্বরাজ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন – এই ত্রি-উপাদান নিয়েই ছিল লীলা নাগের বিপ্লবী জীবন। পোশাকী নাম লীলাবতী নাগ, মা-বাবা ডাকতেন বুড়ি। সংগ্রামী জীবনে প্রবেশ করে পরিচিত হলেন “লীলানাগ”। লীলানাগের জন্ম আসামের গোয়ালপাড়ায় ২ অক্টোবর ১৯০০ সালে। তাঁর পিতা প্রতিভাবান গিরিশ চন্দ্র নাগ ছিলেন বাংলা আসাম গোয়ালপাড়ার মহকুমা হাকিম।
লীলানাগের পিতৃপুরুষের বাড়ি বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার পাঁচগাঁও গ্রামে। সে অর্থে তিনি মৌলভীবাজারের সমাজ কাঠামোর একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। লীলা নাগের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঐতিহাসিক নাগ বাড়ীতে। লীলানাগের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় বিহারের দেওঘরের একটি স্কুলে। ঢাকার ইডেন হাই স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়ে প্রবেশিকা পাস করেন ১৯১৭ সালে। এরপর লীলানাগ কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে বি.এ পাস করে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়তে আসেন। কিন্তু সেখানে সহ শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। লীলানাগের একাগ্রতা ও দৃঢ়তা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য্য স্যার পি.জে হাটর্স মুগ্ধ হয়ে পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। সেই সূত্রে লীলানাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ছাত্রী।
ঢাকাতেই লীলানাগ শুরু করেছিলেন নারী মুক্তির আন্দোলন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীপালী সংঘ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের শুভাগমন ঘটলে দীপালী সংঘ কবিগুরুকে ১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী সম্বর্ধনা জানায়। অভিনন্দন সভায় কবি উচ্চসিত প্রশংসা করে বলেন- ‘এশিয়ার এত বড় মহিলা সমাবেশ আর কখনও দেখি নাই।’ এর আগে গান্ধীজীও চেয়েছিলেন তাঁকে। দীপালীর সম্বর্ধনায় তিনি বলেছিলেন- ‘আমি একজন সীতার সন্ধান করছি, আপনারা সেই সীতার সন্ধান দিতে পারেন।’ রবীন্দ্রনাথের সাথে কাজ করতে না পারলেও গান্ধীজীর সাথে লীলানাগ কাজ করেছিলেন নানাভাবে। ভারতের প্রথম বিপ্লবী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার লীলা নাগের সঙ্গে দীপালী সংঘের সদস্য রূপে বিপ্লবীপাঠ গ্রহন করেন। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর দীপালী প্রদর্শনীর কাজ শেষে বাড়ি ফিরলে লীলানাগ গ্রেফতার হন।
লীলানাগ ছিলেন ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক প্রথম রাজবন্দী। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে কারামুক্তি লাভের পর সিলেটের মহিলা সম্মেলনে তাকে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। ১৯৩৯ সালের ১৩ মে লীলানাগ সহকর্মী দার্শনিক বিপ্লবী অনিল রায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। লীলা রায় ১৯৩১ সালের মে মাসেই প্রথম প্রকাশ করেন “জয়শ্রী” পত্রিকা। তাছাড়া তিনি ঢাকায় বহু শিক্ষা প্রতিষ্টান প্রতিষ্টা করেন। নিজ পৈত্রিক বাড়ীতে স্থাপন করেন কুঞ্জলতা প্রাথমিক বিদ্যালয়। যা আজোও দাড়িয়ে আছে। আলোকোজ্জ্বল সফল এক জীবনের অধিকারী লীলা রায়ের মনে ছিল অসংখ্য অব্যক্ত বেদনা। সাতচল্লিশের ভারত উপমহাদেশের বিভক্তিকে মেনে নিতে পারেন নি। শুধু ভারত নয় এর সাথে বিভক্ত হয়েছিল বাঙালীরা। এ বেদনা তার কাছে ছিল দুঃসহ। স্থির করলেন পূর্ববাংলাই হবে তার কর্মভূমি। রায় দম্পতি ফিরে এলেন ঢাকায়। কিন্তু পাকিস্থান সরকার তাঁদের উপস্থিতি ভাল চোখে দেখল না। জারি হলো গ্রেফতারি পরোয়ানা। বেদনার্ত হৃদয়ে ১৯৪৮সালে রায় দম্পতি তাদের জীবনের প্রিয়তম লীলাভূমি, স্বদেশ-স্বভূমি চিরকালের জন্যে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। সম্পৃক্ত হয়েছিলেন সেদেশের রাজনীতিতে নতুন পরিবেশে।
রাজনগরের পাঁচগাওয়ে লীলা নাগের বাড়ীটি দাড়িয়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। বাংলার নারী জাগরণের উজ্জল দীপশীখা লীলা নাগের স্মৃতি বিজরিত পাঁচগাওয়ে কিংবা রাজনগরে তার নামে নেই কোন প্রতিষ্টান। ১১জুন বিপ্লী লীলানাগের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার মৃত্যুবার্ষিকী জন্মদিনে তাকে নিয়ে মৌলভীবাজারে কোন আলোচনা হয়না। তার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নামকরণের দাবী জেলা বাসীর। নারী অধীকার প্রতিষ্টা কিংবা পরবর্তী প্রজন্মকে স্বদেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ করতে তাকে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ অঞ্চলের সচেতন মহল।