হারুনূর রশীদ: শনিবার ৭ই মে ২০১৬ইং: ৬টা ৫৫মি:
অবশেষে লন্ডনের মেয়র হলেন এমপি সাদেক খান। ৪৫ বছর বয়সী এই যুবক ১১লক্ষ ভোট পেয়ে প্রতিদ্বন্ধী ধনবান জেক গোল্ডস্মিথকে পরাজিত করেছেন। জেক গোল্ডস্মিথ পেয়েছেন ৯লক্ষ ভোট। এ হিসাব চূড়ান্ত নয়। চূড়ান্ত ফলাফল আজ শনিবার ৭ই মে সন্ধ্যার দিকে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সাদেক খান যে মেয়র নির্বাচিত হয়ে গেছেন এটি নিশ্চিত।
কিন্তু কে এই সাদেক খান? যিনি আগামী ৪ বছরের জন্য যুক্তরাজ্যের মত দেশের রাজধানীর দায়ীত্ব নিচ্ছেন?? লন্ডন শহরের উন্নয়ন আর তার বাসীন্ধাদের নানাবিধ সুযোগ সুবিধা দেয়ার কাজে অতীতে তার কি কোন ভূমিকা ছিল কিংবা মেয়র হিসাবে তার নীতিমালায় কি দেখার মত কিছু আছে যা মানুষকে আশ্বস্ত করেছে তাকে নির্বাচিত করতে?
গড়ে উঠা
সাদেক খান, ছোটবেলা থেকেই হাউজিংএর বাড়ীতে থেকে বড় হয়েছেন। সাদিকের জন্মের কিছু আগে ১৯৭০ সালে তার বাবা আমানুল্লাহ ও মা সেহরুন খান পাকিস্তান থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসি হয়ে আসেন। তার বাবা একজন বাস ড্রাইভার ছিলেন। সুদীর্ঘ ২৫ বছর তিনি গাড়ী চালিয়ে সংসার পরিচালনা করেছেন।
ভিন্ন মানুষ আর আরো ভিন্ন সংস্কৃতির অপরিচিত পরিমন্ডলে আসলে, একজন মানুষকে, দুই সংস্কৃতির টানাপোড়েনে দৈনন্দিন জীবনে যে জোড়াতালির মধ্য দিয়ে চলতে হয় সাদেকের বাবা-মায়েরও ছিল সেই অবস্থা। প্রতিনিয়তই তাদের দু’টি ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে আপোষরফা করে চলতে হয়েছে।
সাদেকেরা ৭ভাই এক বোন। সাদেক পঞ্চম। ফলে, স্বাভাবিক কারণেই তার বাল্যকাল ধনীর আদুরে দুলালদের নাচ-গান আর ভ্রমণ-বিলাসে কাটেনি বরং বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেই তাকে বড় হতে হয়েছে। নিরীহ গরীব
অন্যান্য প্রবাসী পরিবারের মত সাদেকও ড্রাইভার বাবার দক্ষিন লন্ডনের ৩ বেডরুমের কাউন্সিলের বাড়ীতে বড় ভাইদের সাথে “বাঙ্কবেড”এ যৌথভাবে নিশী যাপন করে বাল্য কাটিয়েছেন। আর এই বৈষম্যময় অস্বাভাবিকতাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ও মনমানসিকতাই তাকে সাহায্য করেছে বর্তমানে পৌঁছুতে। প্রতিকূলতাকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করার স্বভাব সাদেকের বাল্যের সুপরিচিত চরিত্র। নিজের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছার বিষয়ে সাদেক সেই কিশোর বয়স থেকেই এক দৃঢ় বিশ্বাসী আপোষহীন প্রত্যয়ী মানুষ।
শিক্ষা:
“আরনেষ্ট বেভিন কলেজ” নামে স্থানীয় একটি “কম্প্রেহেন্সিভ” স্কুলে সাদেক লিখা পড়া করেছেন। তার ভাষায় বেভিন কলেজ খুবই কঠিন একটি স্কুল।
সেই সময় ঐএলাকায় মানুষজন “বেভিন বয়েজ” বলে একটি কথা ব্যবহার করতো। যার অর্থ হল “খারাপ ব্যবহার”। এই স্কুল থেকেই সাদেকের রাজনীতিতে আগমন। তিনি ১৫ বছর বয়সে শ্রমিক দলের সাথে যুক্ত হন। স্কুলের ততকালীন প্রধান শিক্ষকের কথা তিনি আজো মনে রাখেন। সেই শিক্ষকের নাম ছিল নাজ বোখারী। যিনি যুক্তরাজ্যের একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেই শিক্ষকের কাছ থেকেই তিনি শিখেছেন যে শরীরের রং কিংবা বংশপরিচয় নিজের জীবন গড়ে তোলার পথে কোন অন্তরায় নয়।
গত বছর যখন নির্বাচনের কথা উঠে তখন শ্রমিকদল শিবিরে সাদেক খানের কোন নাম গন্ধই ছিল না। কিন্তু ঐ যে বললাম হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙ্গিয়ে সামনে আসার অদম্য ইচ্ছা আর পুরুষকেশরী যার আছে তাকে ঠেকায় কে! নিজের জন্য প্রতিকূলতাকে শক্তভাবে মোকাবেলা করে সফলতায় পৌছার বীরত্বময় প্রবণতা কিশোর সাদেকের মাঝে প্রতিভাত ছিল আগেই উল্লেখ করেছি। আর সামনে এগিয়ে যাবার এই জেদই তাকে আজ এ পর্যায়ে তুলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকেই যায় আর তা হল এতো বড়মাপের কাজ সুসম্পন্ন করতে সাদেকের বিচার বুদ্ধি ঠিকভাবে কাজ করবেতো? একমাত্র সময়ই তার জবাব দেবে।
রাজনীতি: শ্রমিক দলনেতা সাদেক খান বৃটিশ সংসদেরও একজন সদস্য হিসাবে ২০০৫ সাল থেকে কাজ করে আসছেন। তিনি দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েছিলেন সাংসদ হিসাবে। সরাসরি সাধারণ ভোটে নির্বাচিত মেয়র হিসাবে সাদেক খান তৃতীয় মেয়র। তিনি পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত একজন সুন্নী মুসলমান। এ পরিচয়ে তিনি লন্ডনের নির্বাচিত প্রথম মেয়র।
ইন্টারনেটে জিহাদের উস্কানীদাতা টুটিং এলাকার বাবর আহমদকে আমেরিকা যখন ১২বছরের জেলদন্ড দেয় তখন সাদেক খান তার পক্ষ হয়ে তার বহিস্কার আদেশের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন।
মেয়র নির্বাচনের প্রচারাভিযানে এই ঘটনাকে সামনে এনে রক্ষণশীলরা নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে জোর নেতিবাচক প্রচার চালায়। বিভিন্ন কায়দায় তারা আরো প্রচার করেছিল যে সাদেক খান নিজেও ভেতরে ভেতরে মুসলমান জিহাদীদের সমর্থন করেন। আর এর প্রমাণ স্বরূপ, টুটিং এলাকার এমপি হিসাবে শ্রমিকদলের ছায়া মন্ত্রীসভার সদস্য থাকাকালীন সাদেকের উপরোল্লিখিত জ্বালাময়ী ভাষণের উদ্ধৃতি দেয় রক্ষণশীলরা। সেই ভাষণে সাদেক, যুক্তরাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়কে উটপাখীর মত বালিতে মুখ লুকিয়ে না থেকে নিজেদের সম্প্রদায়ে বিদ্যমান উগ্র সন্ত্রাসবাদকে মোকাবেলার ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে যে- ”আমি বিশ্বাস করি নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় উগ্রবাদকে মোকাবেলা করার কাজে বৃটিশ মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশেষ ভূমিকা রাখার আছে। তার অর্থ এই নয় যে আমরা উগ্রবাদের জন্য দায়ী, যা এক পক্ষ মানুষ না জেনেই আমাদের দোষ দিয়ে থাকে।
বরং এজন্য যে আমরা অন্যদের চেয়ে কার্য্যকরভাবে উগ্রবাদ দমনে সহায়ক হতে পারি। যেখানেই আমরা মুখ খুলে কথা বলবো, আমাদের ভূমিকা হওয়া উচিত উগ্রমতবাদকে শক্তভাবে মোকাবেলার পক্ষে কথা বলা। পশ্চিমা নীতিমালাই দুনিয়ার সকল অনর্থের মূল বলে আমি মনে করি। আইএসআইএস মানেই যদি হতো দুধ আর মধুর দেশ তা’হলে আমি সেখানে যাবার প্রথম ব্যক্তি হতাম”।
সাদেকও তার প্রচারাভিযানে অকপটে এসব সত্য স্বীকার করে গেছেন। বরং তিনি যে একজন বাস ড্রাইভারের ছেলে, এই কথাটি তাকে বেশী করে নির্বাচনে সাহায্য করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। ফলে, প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীলদের প্রচারের কোন কিছুই কাজ করেনি সঠিকভাবে। প্রকারান্তরে সবকিছুই নেতিবাচক হয়ে কাজ করেছে। গিয়েছে সাদেকের পক্ষে। অবশেষে সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পাড় হয়ে গেছেন সাদেক খান।
ব্যক্তি জীবনে সাদেক কান একজন বাস ড্রাইভারের ছেলে।
ছাত্র জীবনে সাদেক চেয়েছিলেন একজন “ডেন্টিস্ট” হতে এজন্য তিনি এ লেভেল পর্যন্ত অংক ও বিজ্ঞান পড়েছিলেন কিন্তু একজন শিক্ষকের কথায় তিনি মত পরিবর্তন করে আইন পড়ায় মনযোগ দেন। “তুমি সব কথায় তর্ক করো, তোমার আইন পড়া ভাল”। শিক্ষকের এই কথা আর ভিক্টর সিফুয়েন্থেসের ভূমিকায় জিমি স্মিথের টিভি প্রোগ্রাম “লা ল(La Law)”র প্রভাবে তিনি আইন পড়তে যান।
নর্থ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৪সালে সাদেক “ক্রিশ্চিয়ান ফিশার” ল’ফার্মের মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী লুইস ক্রিশ্চিয়ানে সাথে নবীশ সলিসিটর হিসাবে কাজ শুরু করেন। একই বছর তিনি তারই সহকর্মী সলিসিটর সাদিয়া আহমদকে বিবাহ করেন। ঘটনাক্রমে এই সাদিয়া আহমদও একজন বাসচালকের মেয়ে। আনিছা ও আমারাহ নামে তার দু’টি মেয়ে সন্তান রয়েছে।
তিন বছরের মাথায় সাদেক খান মাত্র ২৭ বছর বয়সে সেই ল’ফার্মের অংশীদার হন এবং ফার্মের নাম পরিবর্তন হয়ে নতুন নাম হয় “ক্রিশ্চিয়ান খান”। এসময়ই তিনি গুয়ানায় জন্ম নেয়া স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী বার্থ লুথারস এর অনুপ্রেরণায় নির্বাচন করে টুটিং এর কাউন্সিলার নির্বাচিত হন এবং দীর্ঘ ১২ বছর দায়ীত্ব পালন করেন। সন্ত্রাসী সন্দেহে ৯০দিনের জন্য আটক করে রাখার টনিব্রেয়ার সরকারের আইডি কার্ড পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ৪৮জন শ্রমিকদল বিদ্রুহীদের সাথে মিলে সাদেক খান ভোট দেন। একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে এই পদক্ষেপ ছিল সাদেকের বলিষ্ঠ নীতি নিষ্ঠার পরিচায়ক।
একজন মুসলমান হিসাবে রাজনীতির কারণে ধর্মবিষয়ক কিছু বলতে কখনও লজ্জ্বায় ভোগেননি সাদেক। বরং খোলা মনে হাদিসের উপমা ব্যবহার করেন। তার বাবা তাকে ধর্মীয় বিষয়ে এই হাদিস শিক্ষা দিয়েছেন যে যদি কোন ব্যক্তি কোন কিছু ভুল দেখতে পান তা’হলে তার দায়ীত্ব হল ভুলটাকে সংশোধন করার চেষ্টা করা।
তিনি ফুটবল, বক্সিং এবং ক্রিকেট খেলতে ভালবাসেন। ছেলেবেলায় “সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেছেনও। বহু আগে উইম্বিলডন ও চেলসি’র মধ্যকার এক খেলায় তিনি ও তার ভাই বর্ণবাদী ঝগড়ার শিকার হন। এর পর থেকে তিনি সবসময় ঘরে বসেই খেলা দেখেন, এটাই তিনি নিরাপদ মনে করেন। তিনি লিভারপুলের একজন ভক্ত তাদের ভাল খেলার জন্য।(বিবিসি থেকে সংক্ষেপিত ও হারুনূর রশীদ কর্তৃক অনুদিত)