ঝরা কান্না। সুলক্ষনা প্রিয়দর্শী আমার জীবনসাথীর স্মরণে ক’ফোটা ঝরা কান্না। আজ পুরো ১৪দিন পর কিছু লিখতে বসলাম। এ ২ সপ্তাহ কেনো কিছুই লিখে উঠতে পারিনি তার ব্যাখ্যা অন্য কোন দিন অন্য কোন অবসরে জানাবো না-কি এখনই বলবো ভাবছি। ভাবছি ১৪দিন যে কারণে কোনকিছুই লিখা সম্ভব হয়নি সে কারণটা না বলেই যদি লিখতে বসি তা’হলে আত্মার ক্রন্দন সেই কারণের অমর্যাদা হচ্ছে নাতো! নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন। উত্তরও নিজেকেই দিতে হবে। এমন আবেগী বিষয়ের উত্তর অন্য কারো কাছে আশা করা যায় না।
গত ৪দিন ধরে নিজের কম্পিউটার খুলে কিছু লিখবো ভাব নিয়ে বসি কিন্তু লিখা হয়ে উঠে না। চোখের ঝরা জল বলে যায়- কি লিখবে। কাকে নিয়ে লিখবে। তোমার সতীসাধ্বী জীবনসাথী ছাড়া এখন আর কি আছে যে লিখবে? তাকে নিয়েইতো তুমি লিখবে।
নিজের অজান্তেই অন্তরের গভীরে, মহাকালের অজানা অনন্ত অতলে হারিয়ে যাওয়া আমার জীবন সাথীর হাসিমাখা সুন্দর মুখখানা ভেসে উঠে। মনের মনিকোঠার অধরা তন্ত্রী আকুলি-বিকুলি করে উঠলো। জীবনসাথী হারানোর অব্যক্ত বেদনায় গুমরে কেঁদে উঠলো। আপনাতেই অজোরধারায় চোখে জল নেমে আসলো। মন বেদনায় কুঁকড়ে গিয়ে মহাকালের অতলে ডুবে যায়। চোখের জল ঝড়াতে ঝড়াতে খুঁজতে থাকে তার প্রানপ্রিয় বান্ধব হেলেনাকে। সত্যিকারের সখা হারানোর অন্তর্জ্বালা যে কত গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে তা একমাত্র সে-ই বুঝতে পারে যে এ কাল-অনলে পুড়েছে। যে সাথীহারা হয়েছে। এ বেদনার গভীরতা পরিমাপ করার মত নয়। পুবো শিশুর মত কেঁদে গেলাম কতক্ষন সেও খেয়াল নেই। আজও নিজেকে বুঝাতে পারিনি, জানি তাকে আর কোনকালেও পাওয়া যাবে না। তার পরও আনমনা মন খুঁজে বেড়ায় আকাশের অধরায়, পাতালের গভীরে।
চোখ মুঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিরামহীন কেঁদেই চলেছি। ভাবের জগতে মনোজ্বালা থেকে জানতে ইচ্ছে করছে এ কেমন পৃথিবী। চিরবিদায় যদি নিতেই হবে মানুষ তা’হলে জন্মায় কেনো? একবার চলে গেলে কেনো আর তাকে ফিরে পাওয়া যাবে না। কেনোই বা মায়ায় বাধাপড়ে! মায়া কি তা’হলে সময়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়? মনের এমন অব্যক্ত অবস্থার মাঝেই হেলীর চেহারা ভেসে উঠলো। মনে হলো আমার প্রানপ্রিয় হেলী কথা বলছে।
স্পষ্টই ওর কন্ঠ আমি শুনতে পেলাম। হেলী বলছে- আমাকে বাদ দিয়ে আর কাকে নিয়ে লিখবে! আমার চেয়ে বলিদান আর কে দিয়েছে যে তুমি আমাকে বাদ দিয়ে লিখবে। তুমিতো লেখক নও। একজন সংবাদকর্মি। তা আমাকে নিয়ে সংবাদ লিখেই শুরু করো। আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কি এমন আর এ বিশ্বে ঘটেছে যে সে নিয়ে লিখবে। হয়তো বলবে- লক্ষী প্রিয়তমা আমার, ’করোনা’ দুনিয়ার হাজার লোকের প্রান নিয়ে নিয়েছে, ও নিয়ে লিখতে হবে না। হ্যাঁ, এমন ভয়াবহতা নিয়েতো লিখবেই। তা এমন মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী ‘করোনা’কে প্রাধান্য দেবে, না আমার আত্মত্যাগকে প্রাধান্য দেবে? করোনা ধ্বংসের প্রতিক। আমিতো ধ্বংসের প্রতিক নই। বরং সৃষ্টির মা। ধ্বংসকে রুখে দাঁড়াবে আর লিখবে সৃষ্টিকে নিয়ে, আমাকে নিয়ে।
অবশ্য সে তোমার ইচ্ছা প্রিয়তম। তুমি লিখ বা না লিখ কোনটাইতো আমি আর দেখতে পাবো না। আমিতো এখন অতীতের ছেঁড়া পাতা। মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া লাখো লাখো কোটী কোটী আদম সন্তানের একজন। তবে, একটি কথা তোমাকে শুনতেই হবে। আর কোনদিনতো ফিরে আসবো না। এসে তোমাকে কোন কিছুই বলতেও পারবো না। রোগাক্রান্ত ভাঙ্গা দূর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে তোমার পাশে ঘুমিয়ে থেকে কত কিছুই না বলতে চাইতাম। বুঝতাম তুমিও অনেক কিছু বলতে চাইতে কিন্তু বলতে পারছো না। হয়তো আমার অসুস্থতা তোমাকে বাধা দিত। পেছনে আমি কষ্ট পাই এ তুমি চাইতে না, সে আমি বুঝতাম। আমিও হারিয়ে যাওয়া দিনের অনেক গল্প বলতে চাইতাম। কিন্তু বলতে পারিনি যদি তোমার ঘুম নষ্ট হয়, তুমি ঘুম পাগল মানুষ।
প্রিয়তম, তুমি বুঝতে পারছো না এ আমার বিদায় লগ্ন। এ সময়ে তোমারমত সুন্দর জীবনসাথীকে কষ্ট দিয়ে যেতে চাই না। আমার জীবনের শ্রেষ্ট পাওয়া ছিলে তুমি। কোনদিন মুখ ফুটে এ কথাটি আমি বলতে পারিনি। আমার খুব লজ্জ্বা হতোগো। কিন্তু বিশ্বাস করো, সত্য বলছি তুমি ছিলে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু, পথ প্রদর্শক। তোমার সাথে কত পথ হেটেছি। গেলো ৩৯টি বছর ধরে হেঁটে এসেছি। তোমাকে অনেক ভাবে জ্বালাতন করেছি কিন্তু সে ছিল আমার ভালবাসা বন্ধু। কোনদিনও আমায় ভুল বুঝনা।
গত রাতে তুমি যখন বলেছিলে- হেলী তুমিতো কোন কিছুই করনি যে তোমাকে মাপ করে দিতে হবে। তারপরও বলছি সাথী, তোমাকে ক্ষমা করার কিছুই নেই। তুমি শিশুর মত নিরপরাধ আমার কাছে। আমি হেসেছিলাম তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। সে রাতের সে তৃপ্তি আমাকে আরো বাঁচতে আশা যুগিয়েছিল। তোমার সে কথা ক’টি আমার সামনে বেহেস্তের সুন্দর এক কাননপট এনে দাড় করিয়েছিল। নিজের অজান্তেই চোখে জল এসেছিল। তুমি আমাকে এতো আপন ভাবো, এতো ভালবাসো তা কোন দিন বুঝার চেষ্টা করিনি প্রিয়।(আরো লিখবো)
হারুনূর রশীদ, রোববার, ১২এপ্রিল ২০২০