।।আতাউর রহমান।।
রাজনৈতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম লোকমান আহমদ। সিলেটের ন্যায্য দাবী আদায় ও আন্দোলন-সংগ্রামের আপোষহীন মুখ, সমাজ সংস্কারক লোকমান আহমদ সার্বজনীন একজন বরেণ্য ব্যক্তি। সিলেটের আদর্শিক রাজনীতির উত্তরপুরুষ হিসেবে তিনি সর্বমহলে সমাদৃত।
-
- প্রারম্ভিক জীবন
লোকমান আহমদ সিলেট জেলার নবদ্বীপ খ্যাত পঞ্চখণ্ড তথা বিয়ানীবাজার পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী শ্রীধরা গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে ১৯৫৮ খ্রিস্টীয় সনের ২১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ ফয়জুর রহমান ও মাতার নাম হাজেরা খানম।
- লেখাপড়া :
লোকমান আহমদ-এর লেখাপড়া শুরু শ্রীধরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তিনি কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঠশালা সম্পন্ন করে ভর্তি হন পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ স্কুলে। পিতার কর্মস্থলের সুবাদে সিলেট গভ: পাইলট স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও একই সনে তাঁকে রেসিডেনসিয়েল মডেল স্কুলে (বর্তমান ক্যাডেট কলেজ) ভর্তি করা হয়। এম সি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন মেধাবী লোকমান। এরপর পাড়ি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবতার এক বিমিশ্র টানাপোড়ন সম্পন্ন পরিবারের বড় সন্তান লোকমান আহমদ ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি করবেন-এমন প্রত্যাশা ছিল না তাঁর সফল ব্যবসায়ী বাবার। কিন্তু লোকমান আহমদ রাজনীতিবিদ-ই হলেন। পড়ালেখা আর হয়নি।
- রাজনৈতিক_জীবন :
সিলেটের কৃতি সন্তান আলহাজ্ব লোকমান আহমদ একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। বর্তমানে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সিলেট জেলা জাসদের সভাপতি। সিলেটের মাটিতে লোকমান আহমদ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ক্ষুব্ধ প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি। যুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতার কৈশোর, যৌবনের উন্মাদনায় রাজনৈতিক মাঠে লোকমান নামটি সিলেট শহর ও মফস্বলে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সিলেটের রাজনৈতিক প্রজন্মের যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে উঠেন তিনি। দেওয়ান ফরিদ গাজী, পীর হাবিবুর রহমান, আব্দুল হামিদ, আখতার আহমেদ, ম. আ. মুক্তাদির প্রমুখের পরই সিলেটে লোকমান আহমদ’র উত্থান। সে সময় থেকে লোকমান আহমদ হয়ে উঠেন সিলেটের অন্যতম অভিভাবক। তিনি সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে নৈতিকতার সংগ্রাম করতে গিয়ে শাসকগুষ্ঠির রোষানলে পড়েন। ফলে তিনি অর্ধশতাধিক পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমুলক মামলার শিকার হন। এ সব রাজনৈতিক দূর্বিত্তায়ন, হয়রানি-নির্যাতন, কারাবরণ তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। এই লোকমান আহমদ হুলিয়া মাথায় নিয়ে সামরিক শাসনের পুলিশ আর সেনাদের তাড়া এড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। একদিকে স্বৈরাচার, অন্যদিকে মৌলবাদিরা। অনেক পীড়ন -নিপীড়নের কাহিনী। পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেক রাত। এ সবই এখন লোকমান আহমদ’র জীবন পথের স্মৃতির ইতিহাস।
|
- আন্দোলন_সংগ্রাম :
আপোষহীন লোকমান আহমদ স্বাধীনতা উত্তর সিলেটের রাজনীতিতে সাড়ে চার দশক জুড়ে আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম সারির একজন নেতা ও নীতি নির্ধারক। সিলেটের মাটি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে থাকেন। ‘৭৫ পরবর্তী সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন ও কথিত গণভোট প্রতিরোধ আন্দোলন, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, সাইপ্যাম সিমিটার বিরোধী আন্দোলন, সিলেট সরকারী বালক বিদ্যালয়ের হোষ্টেল রক্ষা আন্দোলন, তেল গ্যাস রক্ষা আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলন, সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন ও সিলেট পৌরসভার উন্নয়ন (জেলখানা থেকে এরশাদকে আল্টিমেটাম) আন্দোলন, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন, সিলেট বিভাগ আন্দোলন এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির নেতার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও লোকমান আহমদ ছিলেন সিংহ বাড়ি রক্ষা আন্দোলন, আর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন, সিলেট নজরুল একাডেমী রক্ষার আন্দোলনসহ সিলেটের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অগ্রসৈনিক।
সাংবাদিকতা : রাজনীতির পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন লেখনি। তিনি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা ও সাময়িকীতে লেখালেখি করতেন। তাঁর একক প্রচেষ্টায় ঢাকা থেকে ‘সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন’ ও সিলেট থেকে পাঠক নন্দিত দৈনিক পত্রিকা “আজকের সিলেট” প্রকাশিত হতো।
- সিলেটের_লোকমান:
কালের স্বাক্ষী এই অগ্রজ লোকমান আহমদ। তিনি সিলেটে সকল আন্দোলন সংগ্রামে সেতুবন্ধনের কাজ করেন ও অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। লোকমান আহমদ’র বড় পরিচয় তিনি একজন আপোষহীন মানুষ। তিনি সিলেট মাটির ন্যায্য সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এক অনুপ্রেরণার বাতিঘর। বর্তমান ধান্দাবাজ, অস্পষ্ট মানুষদের দাপটের সময়েও তাঁর স্বকীয়তা ও ব্যক্তিত্ব অনুকরণীয়। যাঁর বিরুদ্ধে অপকর্ম, অসততা, ধান্দাবাজী, ডিগবাজী, আদর্শচ্যুতি’র কোন অপবাদ নেই। এ রকম প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা আজকাল খুবই নগণ্য। কিভাবে সমাজচিত্রে সাদা’কে সাদা এবং কালো’কে কালো বলতে হয়, তিনি অকপটে তা বলতে পারেন। কারো রক্তচক্ষু তাঁকে দমাতে পারেনি। পাঁচ যুগ পাড়ি দেয়া এই লোকমান আহমদ পরিবর্তন-লড়াইয়ের এখনও প্রার্থীত এক পুরুষ। তিনি এখনও সমাজ বিনিমার্ণের স্বপ্ন দেখেন।
- অবদান :
সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন নাট্য ও সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । সম্প্রতি বিয়ানীবাজার জনকল্যান সমিতির ভবন নির্মাণে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম প্রতিদানযোগ্য। তিনি একজন পরোপকারী লোক। কারো অসুস্থতায় বা চিকিৎসার প্রয়োজনে বন্ধুমহল, আত্মীয় কিংবা পরিচিত স্বজনদের কাছে অত্যন্ত নির্ভরশীল এক আশ্রয়ের নাম লোকমান আহমদ।
- স্বীকৃতি :
লোকমান আহমদ সিলেট ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি ছিলেন সিলেট বিভাগ আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক, সিমিটার-সাইপাম বিরোধী আন্দোলনের নেতা, অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলনের সদস্য সচিব। ‘টিপাইমুখ বাঁধ’ বিরোধী আন্দোলনসহ সিলেট জনপদের অসংখ্য আন্দোলনের রুপকার।
- আড্ডার_ঠিকানা:
এই আদর্শিক লোকমান আহমদ-এর আম্বরখানাস্থ ৭০, বড়বাজার আবাসিক এলাকার “ফয়জুর বাগ” এখনো সিলেটের প্রগতিশীল রাজনৈতিক অঙ্গনের সকল সমস্যা, সংকট আর সম্ভাবনার এক আড্ডাবাজ ঠিকানা। জমে উঠে নানা আলোচনা। এখানেও অন্যরকম সমস্যা আছে। লোকমান আহমদ কথা বলেন দীর্ঘ। নানা মূল্যবান ব্যাখ্যায় তাঁর আলাপ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক নানা ঘটনা, নানা নেপথ্য কথা উঠে আসে তাঁর আলাপচারিতায়। তাতে থাকে অনেক অজানা তথ্য আর না বলা কথার আলোকরশ্মি।
আলহাজ্ব লোকমান আহমদ এর সবই ঠিক আছে। ঠিক নেই শুধু তার ভোজন আর নিদ্রাভ্যাস। সবাই যখন দিনের ক্লান্তি নিয়ে নিদ্রায় মগ্ন তখন লোকমান আহমেদ জেগে থাকেন। তাঁর রাত হয় সূর্য উঠলে। দিন হয় সূর্য ডুবুডুবু করলে। এমন রুটিন নিয়ে আহার নিদ্রার নিয়ম কি আর মেনে চলা সম্ভব!
হে অগ্রজ! আন্দোলন না করে এ পোড়া দেশে কোনও দাবি আদায় হয় না। আপনি বাঁচলে আন্দোলন বাঁঁচবে। লড়াইয়ের পথ ও রথের হাসিটা জোরদার হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট । প্রধান শিক্ষক, দাসউরা উচ্চ বিদ্যালয় ও সভাপতি- বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।
নিউজটি শেয়ার করতে বাটনের উপর ক্লিক করুন