মুক্তকথা: লন্ডন।। শুধু বাংলাদেশে নয় সারা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সংস্কৃতিতে মায়াবী হরিণ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সভ্যতার আদি থেকেই মানব মনীষায় হরিণের স্থান পবিত্র ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক হিসেবে। পুরা কাহিনীতে পাওয়া যায় মায়াবী হরিণ পালন ও শিকারের শিহরণ জাগানো কত কাহিনী। মহাভারতের হস্তিনাপুর প্রাসাদের কাহিনীতে আছে, জঙ্গলে তাঁর স্ত্রী-র সাথে সঙ্গমকালে এক ঋষিকে হরিণ ভেবে পাণ্ডু হত্যা করেন। জনশ্রুতি হল ঋষিকে হত্যা করে পাণ্ডু চেয়েছিলেন ঋষিপত্নীর দখলভোগ। ঋষিপত্নী তার শোধ নিয়েছিলেন পাণ্ডুকে যৌনব্যাধিগ্রস্ত করে। এতো হরিণ নিয়ে মহাভারতীয় হাজারো কাহিনীর একটি।
‘হরিণী কান্দিয়া বলে- শুনো নবী কই তোমারে, বাচ্চা দু’টি বান্ধা আছে গাছেরো তলায় গো’; হরিণ নিয়ে এমন মনমোহিনী গান শুনেনি এমন মানুষ মনে হয় গোটা বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া সিং ছাড়া হরিণ মানব-মানবীর কাছে এতোই আদরের যে তাকে ‘মায়াবী হরিণ’ বলেই দুনিয়ার তাবৎ কাহিনীতে বর্ণনা করা আছে।
স্রষ্টার সুন্দরের প্রতীক সেই হরিণ যদিও বিরল প্রাণী নয় তবুও উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের বনাঞ্চলের মায়াবী হরিণ ধীরে ধীরে বিরল প্রাণীতে পরিনত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অবৈধভাবে হরিণ শিকার একটি কারণ। এছাড়াও বনাঞ্চল উজাড়ের ফলে এসব বনসুন্দর অবুজ প্রানীকূল জীবন ধারনের ঠাই হারিয়ে লোকালয়ে চলে আসায় ঘাতকদের হাতে শিকারে পরিণত হয়। মৌলভীবাজারের পাহাড়ী এলাকায় খাদ্যের অন্বেষণে আবাস ছেড়ে লোকালয়ে হরিণ বেরিয়ে আসার ঘটনা ইদানিং বেড়ে গেছে। লোকালয়ে বেরিয়ে আসা এসব হরিন অবশেষে মানুষের হাতে ধরা পড়ে বিলাসী ভোজন পাতের সামগ্রী হয়।
কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত কুরমা বনাঞ্চল হতে একটি মায়াবী হরিন লোকালয়ে বেরিয়ে আসার পর নির্মম শিকার থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।
গেল বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে কুরমা বিটের আওতাধিন চাম্পারায় এলাকায় গ্রামবাসীরা ধাওয়া দিয়ে আহত একটি মায়াবী হরিন আটক করে। আটকের সংবাদ পেয়ে রাজকান্দি রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রায় চৌধুরী আহত মায়া হরিণটিকে উদ্ধার করে রেসকিউ সেন্টারে পাঠান।
বনবিভাগ সূত্রের বরাতে ‘কমলগঞ্জের কাগজ’ অনলাইন লিখেছে, বুধবার সকালে কুরমা বনাঞ্চল-এর ভিতর থেকে লোকালয়ে বেড়িয়ে আসা আড়াই ফুট উচ্চতার একটি বড় মায়া হরিণকে চাম্পারায় চা বাগান এলাকায় লোকজন জবাই করা জন্য ধাওয়া দিয়ে আটক করে। স্থানীয় কয়েকজনের কাছ হতে খবর পেয়ে চাম্পারায় এলাকায় গিয়ে জবাই করার পুর্ব মুহর্তে গ্রামবাসীর হাত হতে আহত অবস্থায় হরিনটিকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত হরিনটির একটি পায়ে আঘাত রয়েছে। আহত হরিণটিকে উদ্ধার করে বিকাল সাড়ে তিনটায় চিকিৎসার জন্য লাউয়াছড়ায় অবস্থিত রেসকিউ সেন্টার-এ চিকিৎসার জন্য প্রেরন করা হয়েছে।
রাজকান্দি বনরেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর চৌধুরী আহত হরিণ উদ্ধারের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, যথা সময়ে বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে না গেলে হরিণটিকে জবাই করে খেয়ে ফেলা হত।
একই খবর ভিন্ন বর্ণনা দিয়ে ‘বড়লেখা নিউজ২৪’ লিখেছে- মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ‘জবাইকালে’ একটি মাদি হরিণ উদ্ধার করার খবর দিয়েছে বিজিবি। উপজেলার আদমপুরের সংরক্ষিত এলাকা থেকে হরিণটিকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার (০৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শ্রীমঙ্গলস্থ ৪৬ বিজিবি’র দপ্তরে এক প্রেস বিফিংয়ে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর মাহমুদ এ কথা জানান। মেজর মাহমুদ জানান, সকাল ৬টায় বিজিবি কাঁঠালতলী বিওপি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায় একদল লোক একটি হরিণ ধরে জবাই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে-এমন খবর আসে বিজিবি’র কাছে। খবর পেয়ে কাঁঠালতলী বিওপি কমাণ্ডার মো: মালেক ও হাবিলদার বায়রন দ্রুত অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে আহতাবস্থায় একটি মাদি হরিণ উদ্ধার করেন। ওই সময় বিজিবি’র উপস্থিতি টের পেয়ে হরিণ শিকারিরা পালিয়ে যায়। তিনি জানান, হরিণটির গলা ও পায়ে বেশ কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হরিণটির সেবাযত্নের জন্য শ্রীমঙ্গলের ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি সেবা ফাউন্ডেশনের’ চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জন দেব’র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
পাশের আদমপুর সংরক্ষিত বন থেকে শিকারিরা হরিণটিকে ধরে আনে বলে দাবি মেজর মাহমুদের। সীতেশ রঞ্জন দেব জানান, তিনি সেবাযত্ন দিয়ে হরিণটি সুস্থ করে তুলবেন। পরে বিজিবি ও বনবিভাগের উপস্থিতিতে বনে সেটি অবমুক্ত করা হবে।