প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদসহ দলের অনেকে জড়িত ছিল। আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। সে সুযোগটা তারা করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত আছে। তবে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাব। সৃষ্টিকর্তা এবং জনগণ পাশে থাকলে এই লক্ষ্য অর্জনে কোনোকিছুকেই পরোয়া করি না।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ৩৬তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবার গণভবনে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জনগণের উপর বিশ্বাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। অনেকেই তাকে সাবধান করেছিলেন; এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বিশ্বাসই করেননি। আব্বা বলতেন, ‘না, ওরা তো আমার ছেলের মতো, আমাকে কে মারবে?’ তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকের নিয়মিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতেন। ডালিম (শরিফুল হক ডালিম), ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শালি, ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসাই পড়ে থাকত। ওঠা বসা, খাওয়া, দাওয়া সবই। ডালিমের শাশুড়ি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, ডালিমের বউ সারাদিন আমাদের বাসায়। তার শালি সারাদিন আমাদের বাসায়।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, মেজর নূর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেনারেল ওসমানির এডিসি হিসেবে কর্মরত ছিল। তখন কামালও ওসমানীর এডিসি ছিল। দুইজন এক সঙ্গে কর্মরত ছিল। এরাতো অত্যন্ত চেনা মুখ। তিনি বলেন, কর্নেল ফারুক কেবিনেটের অর্থমন্ত্রী মল্লিক সাহেবের শালির ছেলে। এভাবে যদি দেখি এরা কেউ দূরের না, এরাই যড়যন্ত্র করল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়া জড়িত ছিল। জিয়ার যে পারিবারিক সমস্যা ছিল সেটা সমাধানের জন্য সেনাবাহিনীতে এক পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছিল। তার পারিবারিক সমস্যা সমাধান করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান প্রায়ই, প্রতি সপ্তাহে এক বার তার স্ত্রীকে নিয়ে ঐ ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতো। আন্তরিকতা নয়, এদের লক্ষ্য ছিল চক্রান্ত করা। সত্যিকথা বলতে কি সেটা কেউ বুঝতে পারিনি। আমরা খোলামেলা মানুষের সঙ্গে মিশতাম, সকলের জন্য অবারিত দ্বার।
শেখ হাসিনা বলেন, এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে ইতিহাসকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করা, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, স্বাধীনতার যে মূল লক্ষ্য সেটা থেকে বিচ্যুত করা এবং বিজয়কে একেবারে অর্থহীন করে দেওয়ার জন্য।
মোস্তাক তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যারা এভাবে বেঈমানি করে, তারা থাকতে পারে না। মীর জাফরও তিন মাস ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মোস্তাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান করা হয়। এতে স্পষ্ট যে তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল এবং ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আব্বা যখন দেখেছেন, তাকে গুলি করছে, তারই দেশের লোক, তার হাতে গড়া সেনাবাহিনীর সদস্য, তার হাতে গড়া মানুষ, জানি না সেই সময় তার মনে কী প্রশ্ন জেগেছিল? একই দিনে পরিবারের সবাইকে হারানোর দিনটি মনে করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বারবার আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। বারবার চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ভারতে নির্বাসিত জীবনের কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই শেখ হাসিনা বলেন, ভাবলাম দেশের কাছে যাই। কখনও শুনি, মা বেঁচে আছে। কখনও শুনি, রাসেল বেঁচে আছে। একেক সময় একেক খবর পেতাম। ওই আশা নিয়ে চলে আসলাম। কেউ বেঁচে থাকলে ঠিক পাব।
তিনি বলেন, ২৪ আগস্ট দিল্লি পৌঁছলাম। মিসেস গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদের ডাকলেন। ওনার কাছ থেকে শুনলাম, কেউ বেঁচে নেই। হুমায়ুন রশীদ সাহেব আগে বলেছিলেন। কিন্তু আমি রেহানাকে বলতে পারিনি। কারণ ওর মনে একটা আশা ছিল, কেউ না কেউ বেঁচে থাকবে।
শেখ হাসিনা বলেন, দিল্লিতে মিসেস গান্ধী থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ওয়াজেদ সাহেবকে (এম ওয়াজেদ মিয়া) এটমিক এনার্জিতে কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা কী কষ্টের, যন্ত্রণার কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না।’ -ইত্তেফাক থেকে।