প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ।। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের পাক শত্রুদের প্রতিহত করে মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর মুক্ত করেছিল। আজ মঙ্গলবার(৩ ডিসেম্বর) শমশেরনগর মুক্ত দিবস। শমশেরনগর মুক্ত দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় শমশেরনগর সাহিত্যাঙ্গনের উদ্যোগে এক শোভাযাত্রা বের হবে। শোভাযাত্রা শেষে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান শমশেরনগর ডাকবাংলো পরিদর্শন করার কর্মসুচী গ্রহণ করার হয়েছে।
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মুহুর্তে ২৮ মার্চ সর্ব প্রথম মুক্তিযোদ্ধারা একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯জন পাক সেনাকে হত্যা করেছিল শমশেরনগরে। এরপর দীর্ঘ নয় মাস পাক সেনারা শমশেরনগরে শক্ত ঘাটি স্থাপন করে নারকীয়ভাবে নির্যাতন পরিচালনা করে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছিল স্থানীয় বিমান বন্দরের রানওয়ের বধ্যভূমিতে। এখানে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়েছিল। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় ঠিকে থাকতে না পেরে পাক সেনারা ৩ ডিসেম্বর শমশেরনগর ছেড়ে মৌলভীবাজার জেলা সদরের দিকে পিছু হটেছিল। ৪৮ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের প্রতিহত করে মুক্তিযোদ্ধারা কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর মুক্ত করেছিলেন।
শোভাযাত্রা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান দর্শন ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরে ‘শমশেরনগর মুক্ত দিবস’ পালিত হয়। শমশেরনগর সাহিতাঙ্গণের উদ্যোগে ৩ শতাধিক কলেজ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনে শোভাযাত্রা শেষে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান শমশেরনগর ডাক বাংলোর ঐতিহাসিক বটবৃক্ষের তলায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর বেলা ১.৩০ টায় শমশেরনগর সাহিত্যাঙ্গন এর উদ্যোগে শমশেরনগর সুজা মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকদের অংশগ্রহণে প্রায় ২ কিলোমিটার পথ শোভাযাত্রা করে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।
বেলা ২টায় শমশেরনগর ডাক বাংলোর ঐতিহাসিক বট বৃক্ষের তলায় কলেজ শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের অংশ গ্রহনে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতেই ৩ ডিসেম্বর শমশেরনগর মুক্ত দিবস ও শমশেরনগর ডাক বাংলোয় ১৯৭১ সালের কক্ষ সম্পর্কে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শমশেরনগর সাহিতাঙ্গনের প্রধান ও সুজা মেমোরিয়াল কলেজ অধ্যক্ষ ম. মুর্শেদুর রহমান। কবি ও প্রভাষক শাহাজাহান মানিকের সঞ্চালনায় স্মৃতিচারণমুলক বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাঃ(অব:) সাজ্জাদুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা নির্মল দাশ, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই, লেখক ও গবেষক অধ্যক্ষ রসময় মোহান্ত, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ১৯৭১ সালে শমশেরনগর ডাক বাংলোয় নির্যাতনের শিকার শহীদ পরিবার সদস্য সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মছব্বির, সাংবাদিক মুজিবুর রহমান রঞ্জু প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ধলাই সাব সেক্টরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন(অবঃ) সাজ্জাদুর রহমান নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় এগিয়ে যেতে অত্যন্ত আবেগ আপ্লুত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত গল্প বলেন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর তাদের দোসরদের টর্চার সেল শমশেরনগর ডাকবাংলো ও বটগাছের ইতিহাস তুলে ধরেন। বক্তারা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের মধ্যে শমশেরনগর ই সর্ব প্রথম পরিকল্পিত সম্মূখ সমরে ১১জন পাক সেনাকে হত্যা করে ও পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে গর্বিত ইতিহাস রচনা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বক্তারা সরকারের কাছে জোর দাবি জানান, আজও ইতিহাসের স্বাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বট বৃক্ষ, রয়েছে ডাক বাংলো ও নির্যাতন কক্ষ। এগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি এখানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করার দাবি জানানো হয় সরকারের কাছে।
স্মৃতিচারণ মূলক আলোচনার শুরুতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মুহুর্তে ২৮ মার্চ সর্ব প্রথম মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ ৯জন পাক সেনাকে হত্যা করেছিল শমশেরনগরে। এরপর দীর্ঘ নয় মাস পাক সেনারা শমশেরনগরে শক্ত ঘাটি স্থাপন করে নারকীয়ভাবে নির্যাতন পরিচালনা করে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছিল স্থানীয় বিমান বন্দরের রানওয়ের বধ্যভূমিতে। এখানে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়েছিল। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় ঠিকে থাকতে না পেরে পাক সেনারা ৩ ডিসেম্বর শমশেরনগর ছেড়ে মৌলভীবাজার জেলা সদরের দিকে পিছু হটেছিল।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে আবুল ফজল চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ফখর উদ্দিন চৌধুরীর চাচী ও বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল হক চৌধুরী খসরুর মাতা জাহানারা বেগম চৌধুরী স্মরণে এক আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর দুপুরে পতনঊষার ইউনিয়নের আবুল ফজল চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়োজনে বিদ্যালয়ের সভাপতি প্রভাষক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ এর সভাপতিত্বে ও শিক্ষক-কবি নিখিল কান্তি গোস্বামীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অংশ গ্রহণ করেন বিশিষ্ট সমাজসেবক আব্দুল হক চৌধুরী খসরু, প্রধান শিক্ষক মিছবাউর রহমান চৌধুরী, কমলকুঁড়ি সম্পাদক পিন্টু দেবনাথ, কমরেড সাইফুর রহমান, ডা. রাকেশ মোহান্ত, পল্লী চিকিৎসক নুরুল ইসলাম, হারুনুর রশীদ, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য বিপুল বৈদ্য, মসুদ আহমদ, শিক্ষক হারিস মিয়া, শমশের আলী, মোনায়েম খান, শিক্ষার্থী মিনহাজ আহমদ শরিফ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে দোয়া পরিচালনা করেন শিক্ষক মাও: আব্দুল ওয়াহিদ।
বক্তারা বলেন, জাহানারা বেগম চৌধুরী ছিলেন একজন মহিয়সী নারী, সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী ও রতœগর্ভা মা। তিনি ৫ ছেলে ও ৩ মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং পরিবারের সদস্য যুক্তরাজ্য অবস্থান করছেন। বক্তরা জাহানারা বেগম চৌধুরী রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
উল্লেখ্য, গত ২৩ নভেম্বর রাত ৩টা ১৬ মিনিটে লন্ডণস্থ একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।