হারুনূর রশীদ
মানুষ বাঁচেনা, বেঁচে থাকে তার কর্ম। মানব জাতির ক্রমবিকাশের ইতিহাস এই বলে। তার জন্মের শতবর্ষ চলে গেছে। ১৯১৬ সালের ২২মে মানুষটির জন্ম হয়েছিল ভারতের নাগপুরে এক পার্সিয়ান পরিবারে। আসছে ২২শে মে হবে তার জন্মের ১০১ বছর। অন্ততঃ এই সময়টিতে মানুষটিকে স্মরণ করা আমাদের উচিৎ। শুধু উচিৎ বলি কেনো? দায়ীত্বও বঠে। তাই, শ্রদ্ধায় স্মরণ করার এক প্রবল ইচ্ছায় এই লিখা। এই সেই মানুষ যিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের অস্থায়ী সরকারের ঘোষণা ও শপথপাঠ অনুষ্ঠানের উপযুক্ত জায়গা ঐতিহাসিক সেই বৈদ্যনাথতলার আমবাগান বের করে দিয়েছিলেন। ওই বৈদ্যনাথতলাই শেষে মুজিবনগর নামে খ্যাত হয়েছিল এবং আছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের শেষে ইন্দিরা গান্ধী এই রুস্তমজীর নেতৃত্ব বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন- আমাদের প্রতিরক্ষার প্রথম মিথ্যার ঠেলা সামলাতে হয়েছিল বিএসএফ-কে। যে বাহিনীকে এই রুস্তমজীই গড়ে তুলেছিলেন। যে নমুনায় বিএসএফ সেই অগ্নিময় সময়ের মোকাবেলা করেছিল এবং আমাদের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন যুগিয়েছিল তা আমাদের সফলতার নির্ণায়ক ছিল। শুধু প্রয়াত শ্রমতি ইন্দিরা গান্ধীই নন্ আমাদের মুজিবনগর সরকারের প্রতিষ্ঠাকালীন সে মহেন্দ্রক্ষনের বিষয়ে রুস্তমজীকে সকল সাধুবাদ দিয়ে অনেকেই লিখেছেন। বৈদ্যনাথতলার সেই আম্রকানন যা ভারতের একেবারে কাছাকাছি। সদ্য গঠিত বাংলাদেশের নতুন সরকার নিজের স্বাধীন এলাকায় দাঁড়িয়ে শপথ গ্রহন করবে। যুদ্ধ চলাকালিন এমন নিরাপদ ভূমি বাংলাদেশের ভেতরেতো ছিলই না বরং ভারত সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায়ও পাওয়া দুষ্কর ছিল।
সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর দিন-রাতগুলির কাহিনী! দেশের ভেতরে সীমান্তে প্রচন্ড লড়াই চলছে। মাতৃভূমি তখন প্রসব যন্ত্রনায় অস্থির। নতুনকে নিরাপদ নির্বিঘ্নে ভুমিষ্ট করার সে অস্থিরতা যে কি ভয়ঙ্কর অস্থিরতা! সন তারিখ ঠিক হয়েগেছে ঘোষনার। এমন একখন্ড ভূমির প্রয়োজন যেখানে হাজারো চেষ্টায়ও শত্রু আঘাত হানতে সক্ষম হবেনা। নতুন সন্তান ভূমিষ্টের মাতৃ যুদ্ধ। ভয়ঙ্কর সে যুদ্ধের রূপ। একদিকে মায়ের ছটফটানির দুঃখ-বেদনা যদি ভূমিষ্ট হতে গিয়েই শত্রুর কূটজালে আটকা পড়ে মারা যায় সন্তান, অন্যদিকে সরাসরি বিমান আক্রমনের ভয়। এমন এক জঠিল পরিস্থিতিতে মহান সেই দুঃসহসী সৈনিক রুস্তমজী তার জীবনের অভিজ্ঞতার সবকিছু ঢেলেদিয়ে বের করেছিলেন সেই আম্রকাননকে এবং সাজিয়েও দিয়েছিলেন তার সবটুকু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিয়ে।
রুস্তুমজি নিজে থেকেই বুঝে নিয়েছিলেন এমন আগমনের আবাহন অবশ্যই জনসমক্ষে হতে হবে। এবং যত বেশী সম্ভব দেশী-বিদেশীকে নিরাপত্তা দিয়ে জানান দিতে হবে বন্ধু প্রতীম নতুন এই স্বাধীনতার। তিনি জানতেন যা স্বচক্ষে দেখেছেনও কি বিভৎসভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানীরা। নব্য ভুমিষ্ট হতে যাওয়া একটি ভূখন্ডের ঘোষণাকে একদিকে যেমন দেশ ও বিশ্ববাসীকে জানাতেও হবে আবার যে কোন অশুভ আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখতে হবে। এ যে শাখের করাতকে আটকানো। সে মহা কঠিন কাজটিই অত্যন্ত সফলতার সাথে করেছিলেন রুস্তমজী স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। তিনি খুঁজে বের করেছিলেন একেবারে ভারত সংলগ্ন ত্রিভুজ নমুনার সেই বৈদ্যনাথ তলা গ্রামের আম্রবাগানটি। এ যেনো ছিল ইতিহাসের ফিরে আসা। এক আম্রকাননে বাঙ্গালী হারিয়েছিল স্বাধীনতা আর আরেকটি আম্রবাগানে সে দিয়েছিল তার স্বাধীন সরকারের ঘোষণা।
আর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দিয়েছিলেন জাতির দুঃখ-দূর্দশা সময়ের বান্ধব আধুনিক ভারতের নন্দিত পুলিশ কর্তা ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সূতিকাগারের প্রথম জনপরিচালক (ডিজি) প্রয়াত খুসরো ফারামুর্জ রুস্তমজী।
কঠিন সেই সময়টিকে রুস্তমজী তার নিজের ভাষায় বলে গিয়েছেন-
“কোন একটি জাতির প্রথম সরকার গঠনের কাজ কোন সময়ই আলোকোজ্জ্বল, লাল কার্পেট বিছানো, ঝালর ঝুলানো গৃহে আতশবাজীর মধ্য দিয়ে হয় না। এমন কাজের যে স্থান তার শামিয়ানা হয় মুক্ত আকাশ আর তার সাজসজ্জ্বা হয় খোলা আকাশের নিচের বৃক্ষলতা।”
“শতবর্ষ পরে এই বাংলাদেশের মানুষ যখন তাদের জন্মের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাবে তখনই বুঝবে এবং উপলব্দি করবে কি নিদারুণ সংকটময় অবস্থার মধ্যে তাদের প্রানপ্রিয় এ দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। তারা অন্তর দিয়ে বুঝতে সক্ষম হবে এবং অত্যন্ত গর্ববোধ করবে এই বুঝে যে আরো অনেক অর্জনের মত এতো সংকটকালেও তাদের প্রথম সরকার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের শপথ নিয়েছে। তারা বুঝে গর্ববোধ করবে যে তারা এমন এক ভূমিপুত্র যেখানে প্রকৃতি তাদের অফুরান প্রাচুর্য্য দান করেছে যা শুধু বিশুদ্ধ, বা পবিত্রই নয় তারা চিন্তায় প্রত্যয়ী এবং কর্মে দুঃসাহসী নির্ভীক।”
রুস্তমজী নামের এই মানুষটি এতোই অভিজ্ঞ দক্ষ ছিলেন যে ১৯৭৪ সালে তার অবসরের পর ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বিশেষ সচিব হিসেবে দায়ীত্ব দেয়া হয়। এসময় তিনি বিএসএফ, ইন্দো-তিব্বেতান বর্ডার পুলিশ, সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়েল সিকিউরিটি ফোর্স ইন দি সেন্ট্রাল পুলিশ অরগেনাইজেশনকে ঠিকঠাক করে গড়ে তুলেন। ‘ইন্ডিয়ান কোস্ট গার্ড’ ও ‘ন্যাশনেল পুলিশ কমিশন’ গঠন তিনিই শুরু করেছিলেন। পরে ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি এসবের সদস্য হিসাবে কাজ করেছিলেন।
এই রুস্তমজীর কাজের অনেক কিছুই অনেকেই জানেন না। ১৯৭৮ সালে কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে রুস্তমজী বিহার রাজ্যের জেল দেখতে যান। পরে, জেলের ভেতরে বিনা বিচারে আটকদের জীবনের মূল্যবান সময় বিনষ্টের বিষয়ে লিখেন। ওই সময় ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ তার দু’টি লিখা আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার ওই দুই লিখা পরবর্তীতে প্রথম ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন কেইস- ‘হুশেইনারা খাতুন বনাম স্টেট অব বিহার’ এর ভিতভূমি হয়ে উঠেছিল। যার ফলে সারা ভারতের ৪০ হাজার বিনাবিচারের কয়েদিকে খালাস দিতে হয়েছিল।
১৯৭২ সালে তিনি ভারতের সেরা পদবী পদ্মভূষণ এবং ১৯৯১ সালে পদ্ম বিভূষণ উপাধিতে বিভূষিত হন। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে এই কীর্তিমান দেহত্যাগ করেন।
-সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সাহেবের লিখা ও ‘দি পাইওনিয়ার’ অনলাইন অবলম্বনে।