স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ইউ কে বিডি টিভির
বিশেষ আলোচনার অনুষ্টান স্মৃতির মনিকোঠায় সামাদ আজাদ
বদরুল মনসুর
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও মানণীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহচর, ৫২ এর ভাষা সৈনিক, ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় নেতা, আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ইউ কে বিডি টিভির উদ্দ্যোগে গত ৩মে সোমবার বিকাল ৫টায় স্মৃতির মনিকোঠায় সামাদ আজাদ শিরোনামে এক বিশেষ আলোচনার আয়োজন করা হয়।
আলোচনায় বক্তাগন প্রয়াত এই রাজনীতিককে নিয়ে তাদের হৃদয় নিংড়ানো সুললিত ভাষায় যা বলেন তা’হলো- বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আব্দুস সামাদ আজাদ একটি উজ্জ্বল নাম। মাটি থেকে মহিরুহ সামাদ আজাদ একজন ত্রিকালদর্শী রাজনীতিবিদ। ব্রিটিশ আমলে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পাকিস্তান আমলে একজন সংগ্রামী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে এর অভ্যূদয় ও রূপান্তরের এক অন্যতম কান্ডারি। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে অসামান্য অবদান রাখেন এই ক্ষণজন্মা পুরুষ। মেধা ও বিচক্ষণতা দিয়ে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এক সফল দৃষ্টান্ত আব্দুস সামাদ আজাদ।
আপাদমস্তক রাজনীতিক সামাদ আজাদ সারাজীবন প্রগতিশীল ধ্যান ধারণা লালন করেছেন। উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ ও কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বিশাল কর্মপরিধি তাঁকে পরিণত করে এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে।
আব্দুস সামাদ আজাদের তিরোধান বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর শূন্যতার সৃস্টি করে। দল, মত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর হৃদতা। একজন সদালাপী, কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে দলের প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ে তাঁর ছিল ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। রাজনীতির ধ্যান জ্ঞান এই জননেতা গভীর রাত পর্যন্ত কর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। বৃদ্ধ বয়সেও অসুস্থ শরীর নিয়ে সাংগঠনিক প্রয়োজন আর সামাজিক অনুষ্ঠানে ছুটে বেড়াতেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। শুধু নিজ দলের কর্মী নয় ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গেও সদ্ভাব রাখতেন। প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ এই বর্ষিয়ান নেতা ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানুষ। আজন্ম গণতন্ত্রী, দক্ষ সংগঠক, সংগ্রামী এই জননেতা প্রকৃতঅর্থে ছিলেন রাজনীতির একজন সাধক পুরুষ। বৃহত্তর সিলেটের রাজনীতি ও সামাজিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন সর্বজন গ্রহণযোগ্য অভিভাবক। জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।
বক্তারা সুনামগঞ্জের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আব্দুস সামাদ আজাদ এর নামে নামকরণ করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।
আব্দুস সামাদ
প্রয়াত আব্দুস সামাদ আযাদ, ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুস সামাদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি আব্দুস সামাদ নামেই পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি নামের সঙ্গে আজাদ সংযুক্ত করেন। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের মাধ্যমে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পরবর্তীতে আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি পদও অলংকৃত করেন।
১৯৪৮ সালে আবদুস সামাদ আজাদ সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনীতির কারণে এম এ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিতে পারেননি। মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত হয়ে গেলে আবদুস সামাদ আজাদ নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। গণতান্ত্রিক যুবলীগের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৭২ সালে নয়া দিল্লীতে ইন্দিরা গাঁধীর সাথে আব্দুস সামাদ আযাদ। ছবি কৃতিত্ব: দি ওয়ার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬
আব্দুস সামাদ আজাদ একজন ভাষা সংগ্রামী। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেট সফরে আসলে তিনি একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। বাংলা ভাষার দাবিতে সিলেটে সংগঠিত আন্দোলন, সংগ্রামে তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। পরে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তিনি সম্পৃক্ত হন। প্রথমে সিলেট পরে ঢাকায় এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে দশজনি মিছিল করার প্রস্তাবকও ছিলেন তিনি। ঐদিন তিনি গ্রেপ্তার হন ও কারাবরণ করেন।
১৯৫১ সালে নতুন রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে গণতন্ত্রী দলের প্রার্থী হিসেবে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(ন্যাপ) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে ন্যাপের সহ-সম্পাদক ও দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন।
আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর আব্দুস সামাদ আজাদের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু এক সময় গ্রেপ্তার হন। প্রায় চার বছর জেলে থাকার পর ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে তিনি আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং বৃহত্তর সিলেট আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া আপাদমস্তক রাজনীতিক এই জননেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদ গঠনে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারে মন্ত্রী পরিষদের উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জননেতা সুলতান মাহমুদ শরীফ এর সভাপতিত্বে এবং ইউকে বিডি টিভির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ মকিস মনসুর এর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক জননেতা শ ম রেজাউল করিম এমপি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সাধারন সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক এম এ সালাম, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা আব্দুল আহাদ চৌধুরী, নিউইয়র্ক স্টেট আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা শাহিন আজমল ও ইউকে বিডি টিভির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও বৃস্ট্ল প্রেসক্লাবের সম্পাদক খায়রুল আলম লিংকন সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
|