মুক্তকথা নিবন্ধ।। কেউ মানেন কি মানেন না, সেটি বড় কথা নয়; আসল কথা হলো সারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বড় ধরনের এক মন্দাভাব চলছে। বিশ্বের ৫ম শক্তিধর রাষ্ট্র বৃটেন আজ ৪ বছর হতে চলেছে, তারা ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে থাকবে কি থাকবে না এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। এখন আবার শুনা যাচ্ছে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এই ‘ব্রেক্সিট’ সমস্যার সমাধান আম সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার পায়তারা চলছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তাবড় তাবড় ‘থিঙ্ক ট্যাংক’ থাকতে এমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যার সমাধান নিজেরা খুঁজে বের করতে না পেরে সাধারণ মানুষের উপর ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। তারা কি এ বিষয়টি বুঝতে পারছেন না যে তাদের মত বিদ্যানের দল ৪বছরেও যা পারেননি, দেশের আম সাধারণ মানুষ যাদের পেশা রাজনীতি নয়, তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এ বিষয়টি সমাধানের পথ খুঁজে বার করবে কি দিয়ে? ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন এক জিনিষ আর ‘ব্রেক্সিট’এর মত একটি রাজনৈতিক বিষয়ের ফয়সালা ভিন্ন বিষয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়ীত্ব তা’হলে কি? শুধুমাত্র আরব আমিরাত, সৌদি, অষ্ট্রেলিয়া আর ক্যানাডার অবস্থা একটু ভিন্ন। ভিন্ন বলতে এই নয় যে তারা সবেই মহাকল্যাণ রাষ্ট্র! বরং ইউরোপের বহু রাষ্ট্রের চেয়ে তারা অনেক অনেক পেছনে এখনও। সৌদি ও আরব আমীরাতের সুবিধা, অঢেল তেলের মওজুদ সাথে মানুষ এতই কম যে এখনও তাদেরকে বাহিরের দেশ থেকে শিক্ষিতসহ সাধারণ কাজের লোক ভাড়া করে নিতে হয়। কানাডা প্রচণ্ড শীতের দেশ, প্রচুর ভুমি, মাটির নিচে অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদ অন্যদিকে মানুষ অনেক কম। অষ্ট্রেলিয়া শীতের দেশ নয় কিন্তু এক দেশই একটা মহাদেশ। সে অনুপাতে সম্পদ এখনও অনেক অনেক বেশী আর মানুষ অনেক কম। কিন্তু বিদেশী নেয়ার বিষয়ে তারা অমানবিকভাবে অনাগ্রহী। বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দাভাব যেমন নতুন কিছু নয় তেমনি অস্বাভাবিক কিছুও নয়। মন্দাভাব হতেই পারে। তবে দেখার বিষয় সে মন্দাভাব প্রাকৃতিক না-কি মানুষেরই তৈরী! অধুনা এ মন্দাভাবটি শুরু হয়েছিল আমার জানামতে নব্বুইয়ের দশক থেকে। এসময় আমেরিকা ও বৃটেন এ দুই পরাশক্তির দেশে দর্শনীয়ভাবে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছিল। মন্দার কারণ ছিল- এই মন্দা কাটানোর নামেই মিথ্যা সাজানো কারণ দেখিয়ে ইরাকের সাথে অহেতুক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। ধনবানদের নীতি- একটি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে নতুন করে লুটপাটের সুযোগ তৈরী করা। তাই করেছিল আমেরিকা। সাথে সঙ্গী হয়েছিল অষ্ট্রেলিয়া, বৃটেনসহ আরো অনেক। অতীতের ওলন্দাজ জলদস্যু বলে ইতিহাসখ্যাত নেদারল্যান্ডও সাথে ছিল। এরও বহু আগে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানি বিপ্লবের ফলে মার্কিন-সমর্থিত ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি অন্যতম শক্তিশালী মিত্ররাষ্ট্রকে হারিয়েছিল। যে ক্ষতি আজ অবদি আমেরিকা পুনোরুদ্ধার করতে পারেনি। পারেনি কেবলমাত্র তাদের ধনবাদী যুদ্ধংদেহী তত্ত্বের কারণে। প্রেমভালবাসার মধ্য দিয়ে দুনিয়াকে সুন্দরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এমন চেষ্টা তাদের কোনকালেই ছিল না। ফলে এমন কথা যে এ বিশ্বে আছে এবং দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ এর অনুশীলন করছে এমন সত্য তথ্যের কথা এরা ভুলেই গেছে। বলতে গেলে এসব দেশের জনগুষ্ঠীর অধিকাংশই এখন শুধু বুঝে ব্যবসা আর কূটকৌশলে পরের সম্পদ লুটপাট। ১৯৯১সাল থেকে শুরু হয় মিথ্যা অজুহাতে ইরাকের সাথে যুদ্ধের পায়তারা। ১৯৯১ থেকে ২০০৩সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘকালের একযুগ পর্যন্ত সময় নিয়ে জাতিসংঘ পরিদর্শক দিয়ে ইরাকে ‘মানবতাবিধ্বংসী’ ক্ষেপনাস্ত্র খুঁজেও পাওয়া যায়নি। উপরন্তু জাতিসংঘ পরিদর্শকদের উপস্থিতিতে ইরাক বিপুল পরিমাণ গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করে। ১৯৯৮সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ পরিদর্শকদল ইরাকেই ছিল। তারপরও ইরাকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ যুদ্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল লুটপাট। ২০০১সালেই বুশের আমেরিকা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই ইরাক যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০লাখের মতো ইরাকী মারা গেছেন। উদ্বাস্ত্ত হয়েছেন ২৫লাখ ইরাকী। বাড়ীঘর হারিয়ে পাশের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন আরো ১৫লাখ ইরাকী। প্রায় একই অবস্থা হবে সিরিয়ার বেলায়। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন দ্বারা গঠিত স্যার জন চিলকোটের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশন ২০১৬সালের ৬ই জুলাই ইরাক ইনকোয়ারি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সাত বছর ধরে অসংখ্য শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং তা যাচাই- বাছাইয়ের পর এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। প্রায় ২৬ লাখ শব্দের ৮ হাজার পৃষ্ঠার এই ইরাক তদন্ত বিবরণে বলা আছে, ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল। আরো বলা হয়েছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের সব পথ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল বৃটেন। ওই রিপোর্টে আরো যা বলা আছে তা হলো- সামরিক শক্তি প্রয়োগই একমাত্র ও শেষ অবলম্বন এমন পরিস্থিতি ছিল না। সে সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে সর্ব অবস্থায় তার সাথে থাকার কথা উল্লেখ করে গোপনে লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। ইরাকে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে এর পরই খুবই পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ শুরু করা হয়েছিল সিরিয়ায়। যে যুদ্ধ বলতে গেলে এখনও চলছে। এভাবেই দুই পরাশক্তি যুদ্ধ দিয়ে মন্দা থেকে উদ্ধারের অবৈজ্ঞানিক অনৈতিক মানবসমাজবিধ্বংসী ভঙ্গুর পথে দুনিয়াকে ঠেলে দিয়েছেন। আর আমরা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ আজও এর খেসারত দিয়ে যাচ্ছি। |