শুধু ভাষার নয়, বাঙ্গালীর সকল অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে নারীরা পিছিয়েতো ছিলেনই না বরং তারাই ছিলেন অগ্রসেনানী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে জীবন দিয়ে গেছেন তারা। রাজনগরের লীলা নাগ তাদের অন্যতম। বাংলায় বায়ান্নের সে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনে নারীদের প্রভাতফেরী গোটা বাংলার নারীদের মাঝে প্রেরণা ও উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলে আন্দোলনকে দিয়েছিল ভিন্নমাত্রা। নারীদের সে আন্দোলনী রূপ উজ্জীবিত করেছিল বহুকে। তেমনি একজন ছিলেন সিলেটের ঢাকাদক্ষিনের কমলা ভট্টাচার্য। বাংলাভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুধু যে পাকিস্তানে হয়েছিল তা’নয়। উনিশ’শ বায়ান্ন সালে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে বাংলাভাষা নিয়ে পাক ষঢ়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন বা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সে একই নমুনার আন্দোলন-যুদ্ধ ভারতের আসামের শাসকগুষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানের ছাত্রজনতাকেও করতে হয়েছিল। আসামের ছাত্র-জনতার সে আন্দোলন ছিল একটু ভিন্ন রূপ ও মাত্রার। পাকশাসকচক্র বাংলাভাষাকে একেবারে তুলে দিয়ে কেবল উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। সে ছিল ১৯৫২ সালের ঘটনা। তার ঠিক ৮বছর পর সে একই নমুনায় আসামের বিমলা প্রসাদ চলিহা’র অসমীয়া শাসকচক্র বাংলাকে বাদ দিয়ে কেবল অসমিয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা করতে ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর প্রস্তাব রেখেছিল। উত্তর করিমগঞ্জের একজন বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস সে প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন। সে বিরোধীতার পথ বেয়ে ১৯৬১সালের ১৯মে ডাক এসেছিল হরতালের। হরতাল ও পিকেটিং হয়েছিল শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।আন্দোলনকারীদের বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ১৭ রাউণ্ড গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই ৯জন নিহত হয়েছিলেন। পরে আরো ২জন মারা গিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আসামের কূচক্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা সরকারের পুলিশের গুলিতে সেদিন সে ১৯মে যারা প্রান বলিদান করেন তাদেরই একজন হলেন সিলেটের ঢাকা দক্ষিনের কন্যা ১৬ বছর বয়সী যুবতী কমলা ভট্টাচার্য। মায়ের ভাষার আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে নেমে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন তিনি ভাষার জন্য। ভাষার দাবিতে প্রাণ হারানো তিনিই প্রথম নারী শহীদ। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, কমলার জন্ম ছিল ১৯৪৫ সালে সিলেটের ঢাকা দক্ষিনে। পিতা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর ছেলে মেয়েসহ ৭ সন্তানের মধ্যে কমলা ছিলেন পঞ্চম। চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় ১৯৫০ সালে মাত্র পাঁচবছর বয়সে অন্য আরও অনেকের মতো জন্মস্থান ছেড়ে মায়ের সাথে আসামের শিলচরে গিয়ে আশ্রয় নেয় পিতৃহারা কমলা ও তাদের পরিবার। শিলচরেই বসবাস শুরু করেন কমলারা। শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। কমলার মেজ দিদি প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। তার শিক্ষকতার অল্প আয় দিয়ে কোনোরকমভাবে চলতো সংসার। কমলা ভর্তি হন শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইন্ষ্টিটিউটে। কিন্তু স্কুলের বই-পত্র কেনার ক্ষমতা ছিল না তার। কমলা একবার বড়দিদি বেণুকে একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেননি। কমলা তার সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে তার বিষয়বস্তু খাতায় টুকে নিতেন। ১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরিক্ষায় বসেন। তার ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি স্নাতক পর্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে তিনি টাইপরাইটিং শিখে চাকরি-বাকরি করবেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে একটি পিকেটিংএর ডাক দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালের ১৯ মে, সকালে অনেকের সাথে কমলাও পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। কমলার মা কমলাকে এক টুকরো কাপড় দেন কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কমলার সাথে বেড়িয়ে পড়ে কমলার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও তার বড়বোনের ছেলে বাপ্পা। সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধা হয়। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই আসাম রাইফেল্সের বন্দুকধারীরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা ২-৩৫ নাগাদ আকস্মিক তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে শুরু করে। |