1. muktokotha@gmail.com : Harunur Rashid : Harunur Rashid
  2. isaque@hotmail.co.uk : Harun :
  3. harunurrashid@hotmail.com : Muktokotha :
প্রাচীন গুরুকূল ২ - মুক্তকথা
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন

প্রাচীন গুরুকূল ২

তনিমা রশীদ॥
  • প্রকাশকাল : সোমবার, ৭ জুন, ২০২১
  • ৯০৪ পড়া হয়েছে

রাজারা তখন তাদের সন্তানাদি গুরুর কাছে শিক্ষার জন্য একবারে পাঠিয়ে দিতেন। উপানিষদ অনুযায়ী, সেখানে শিক্ষা দেয়া হতো পুরো বারো বছর ধরে। সেখানে সংগীত, কলা, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, সমরাস্ত্র বিদ্যা, সাহিত্য, নানা দেশের নানা গীতিকথা ইত্যাদি শেখানো হত! এককথায়, গুরু যা-ই জানতেন, শিষ্যকেও তার সবটুকু উজার করেই শেখাতেন!
তার মস্তিষ্ক ভাণ্ডারে সঞ্চয় হয়ে থাকত জীবন থেকে পাওয়া প্রচুর অভিজ্ঞতা। বাণপ্রস্থী গুরুরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি ছাত্রদের সামনে জ্ঞানের আকারে তুলে ধরতেন। তাই, বলা যায়, প্রাচীন ভারতের শিক্ষাধারা জীবনের নানা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ছিল। আর আমরা তো জানি জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিই আমাদের অনেক কিছুই শেখায়, তারা প্রত্যেকেই আমাদের শিক্ষক। আর যখন শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তুলে ধরার কথা উঠছে। তখন প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা মানবজীবনের ও মনের কতটা কাছে ছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি! আর একটা অসাধারণ ব্যাপার না বললেই নয় তা হলো প্রাচীন বৈদিক সমাজে ছাত্রদের শিক্ষাদান করা হতো মূলত শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে (অন্তর্জাল থেকে পাওয়া)। এই তিন পদ্ধতির সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়া যাক।

প্রথমে, গুরু যে পাঠ দিতেন ছাত্ররা তা শুনত। এই পদ্ধতিকে বলা হতো শ্রবণ। শোনার পর ছাত্ররা সবাই মিলে তা আবৃত্তি করার চেষ্টা করত। এরপর তারা ব্যক্তিগতভাবে গভীর চিন্তার দ্বারা তা মনে রাখার চেষ্টা করত। এই গভীরভাবে চিন্তা করার পদ্ধতিকে বলা হতো মনন। তারপর, তারা একাগ্রচিত্তে ধ্যানের মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করত। এই ধ্যান করে সত্যকে উপলব্ধি করাকে বলা হতো নিদিধ্যাসন আর এই নিদিধ্যাসনের দ্বারা তারা জ্ঞানলাভ করত। এরকমভাবেই শিক্ষার্থীদের মাঝেও শিক্ষাগ্রহণের একাগ্রতা বৃদ্ধিলাভ করত। তবে, একাগ্রতা বৃদ্ধির জন্যে শিক্ষার্থীরা রোজ জপ-ধ্যানও করত। আজকের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি কল্পনা করতে পারবে কি না সেই ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এই শ্রবণ ও মনন পদ্ধতির ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় জেনে রাখা ভালো যে প্রাচীনকালের শিক্ষার্থীরা যে বেদ পাঠ করত তা অনেক বছর লিপিবদ্ধ করা হয়নি। যদিও ঐতিহাসিকদের মতে প্রাচীনকালে অর্থাৎ বৈদিক যুগে মানুষ লিপির ব্যবহার জানত না, কিন্তু বর্তমান যুগের ঐতিহাসিকদের মতানুযায়ী বৈদিক যুগেও মানুষ লিপির ব্যবহার জানত। তাহলে লিপিবদ্ধ হয়নি কেন? এর উত্তরে অনেকেই বলেন যে, হয়তো শিক্ষার্থী বা শিষ্য গুরুর কাছ থেকে সরাসরি নেওয়া শিক্ষা শ্রবণ মনন ও নিদিব্যাসনের মাধ্যমে ধ্বনি ও ছন্দ অক্ষুন্ন রাখতে পারবে এবং শিষ্যের একাগ্রতা ও মনে রাখার ক্ষমতাও বৃদ্ধিলাভ করবে বলে লিপির ব্যবহার প্রচলন থাকলেও বেদ লিপিবদ্ধ হয়নি। এর থেকে প্রাচীন ভারতীয়দের একাগ্রতা ও স্মরণ ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রতিফলিত হয়।

প্রাচীন ভারতে বিদ্যা দু’ভাগে বিভক্ত ছিল যথা- (১) পরা বিদ্যা ও (২) অপরা বিদ্যা। এখন বিদ্যার এই দুই বিভাগ বিষয়ে কিছু কথা জেনে নেয়া ভাল হবে।
(১) পরা বিদ্যা : সাধারণত ব্রহ্মবিদ্যাকে পরা বিদ্যা বলা হতো। এই পরা বিদ্যার অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঈশ্বরলাভ বা নিজের প্রকৃত স্বরূপ বা ‘আমি’কে উপলব্ধি করত। আর এই ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলনের ফলে শিক্ষার্থীরা পরম শান্তি ও অমৃতত্ব লাভ করত। এর থেকে বলতে পারি যে প্রাচীন ভারতে শিক্ষার্থীরা এখনকার মতো স্ট্রেস, টেনশন বা দুশ্চিন্তা নিয়ে চলত না, বরং তারা এক পরম শান্তিতে এবং আত্মপোলব্ধি লাভের মাধ্যমে শিক্ষালাভ করত। অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীরা পরাবিদ্যা লাভ করার জন্য ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা শিক্ষার্থীজীবন থেকে সরাসরি সন্ন্যাসী হতো। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচীন ভারতে বেশিরভাগ মানুষই গার্হস্থ আশ্রম শেষ হলে ঈশ্বরলাভের সাধনায় ব্রতী হতেন। আসলে প্রাচীন ভারতে মানুষের জীবনের লক্ষ্যই ছিল “ঈশ্বরলাভ করা আর সম্বল ছিল ত্যাগ। ভোগের জীবন তারা বর্জন করে সৃষ্টিকর্তাকে জানাই যে জীবনের পরম ব্রত তা তারা ভালোভাবেই জানতেন।
(২) অপরা বিদ্যা : প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে শিক্ষার্থীদের বেদ, বেদাঙ্গ, ষড়দর্শন এবং নানা সূত্র সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হতো। তবে বৈদিক যুগের শেষে শিক্ষার্থীদের চতুর্বেদ ছাড়াও বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, নক্ষত্রবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা, শিল্প, ব্রহ্মবিদ্যা, ইতিহাস, পুরাণ ইত্যাদি বিষয় পড়তে হতো। এই যে বিজ্ঞান, কলা, শিল্প প্রভৃতি ব্যবহারিক বা লৌকিক বিদ্যার অনুশীলন করাকে ‘অপরা বিদ্যা’ বলা হতো। এই অপরা বিদ্যা পাঠের মাধ্যমে সংসারে অর্থলাভ করার উপায় জানা যেত। অপরা বিদ্যালাভ করার পর বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গার্হস্থ আশ্রম বা সংসারজীবনে প্রবেশ করত। প্রাচীন ভারতে প্রয়োগিক বা ব্যবহারিক বিদ্যাদান করা হতো শিক্ষার্থীকে যাতে সে তার বিদ্যাকে প্রয়োগ করে নিজে স্বাবলম্বী হতে পারে। তাই সে সময় শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে সেই ভাবেই তাদের শিকর মজবুত করে তোলা হতো। কিন্তু সে যা-ই হোক। সাহিত্য, জ্যোতিষশাস্ত্র, কলা, সংগীত, রণকৌশল, শিষ্টাচার, রাজ শিষ্টাচার, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি নানা বিষয়ে গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা নেবার পেছনে উদ্দেশ্য কি ছিল?
উল্লেখ্য, সমাজের নিচু বর্গের মানুষ, দলিত শ্রেণী, নিচু বর্ণের মানুষদেরকে এই গুরুর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হত কেন? শিক্ষার্থীর আত্মিক উন্নয়নেও বা কতটুকু কার্যকর ছিল এই শিক্ষাব্যবস্থা!

অতসব বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যই ছিল রাজপরিবারকে শক্তিশালী থেকে মহাশক্তিশালী আর মহাশক্তিশালী থেকে পরাক্রমশালী রূপে তৈরি করা, যাতে করে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজ অঞ্চলের মানুষকে শোষণ করা যায় আর নিজ অঞ্চলকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু এর পরপরই উপমহাদেশে শুরু হয় আবার অন্য রকমের শিক্ষাবিপ্লব, যাকে বিহার বিপ্লব বললেও ভুল হবে না। এই বাংলাদেশ অঞ্চলে তথা আমাদের প্রাচীন বঙ্গেই এই বিহার বিপ্লবের নিদর্শন এখনও অনেকটাই অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। সোমপুর বিহার, শালবন বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ময়নামতি বিহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সেই যুগে গুরুকে পারিশ্রমিক প্রদানে কেউ বাধ্য নয়! গুরু দৃশ্যত, কারো মুখাপেক্ষী নয়, বরং নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষা দান করেন এবং শিষ্যদেরকেও নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান বিলিয়ে দিতে সবসময় উদ্বুদ্ধ করে যেতেন। কিন্তু যে কথাটা প্রায়শই লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে, অধিকাংশ গুরুই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শাসকগোষ্ঠীর সুশীতল ছায়ার আশ্রয়ে নিজ নিজ কার্যাদি পরিচালনা করতেন। ব্যতিক্রম তো আছে বটেই, কিছু গুরু নিজেদেরকে সাধক, একজন পরিপূর্ণ সাধক বানানোর প্রচেষ্টাতেই নিমগ্ন থাকতেন! যারা কি না দিনে একবার, তিন দিনে একবার খেয়ে শিক্ষা দানের কাজটাও চালিয়ে যেতেন। আর শিক্ষার পূর্ণতা প্রাপ্তি হলে সেকালে গুরুদক্ষিণা দেবার রেওয়াজ ছিল। তবে এটা দিতেও কেউ বাধ্য ছিল না। অধিকাংশ অভিজাতের সন্তানই গুরুদক্ষিণা দিয়ে যেত। আর গুরুদের মাসিক কিংবা সাপ্তাহিক দক্ষিণার ব্যবস্থাও ছিল। ঠিক এমন যে, কোনো এক ছাত্র আসার সময় বাড়ি থেকে হাতে করে একটা লাউ নিয়ে আসলো, আরেকজন একটা মিষ্টি কুমড়া নিয়ে আসলো। এই লাউ, কুমড়াই দক্ষিণা!

বিদ্যার্জন সমাপ্ত হলে শিষ্যরা স্নান করে এসে গুরুকে প্রণাম করতেন। গুরু তখন তার শিষ্যদের আশীর্বাদ করতেন এবং উপদেশ দিতেন যে তারা যা যা বিদ্যার্জন করেছে তা যেন যথাযথভাবে কাজে লাগায়। ছাত্ররা ওই বিশেষ দিনটিতে বিশেষ উদ্দেশ্যে স্নান করার পর ‘স্নাতক’ (আজকের দিনে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গ্র্যাজুয়েশন’) আর স্নান করার পরে গুরুর দ্বারা ছাত্রদের ওই বিশেষ আশীর্বাদ প্রাপ্তির অনুষ্ঠানকে বলা হতো ‘সমাবর্তন’ (আজকের দিনে ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘কনভোকেশন’)। তবে, বর্তমান ভারতবর্ষে স্নাতক ও সমাবর্তন অনুষ্ঠান প্রাচীন আমলের স্নাতক ও অনুষ্ঠানের একেবারেই অমিল।(আগামী পর্বে সমাপ্ত)

এ জাতীয় সংবাদ

তারকা বিনোদন ২ গীতাঞ্জলী মিশ্র

বাংলা দেশের পাখী

বাংগালী জীবন ও মূল ধারার সংস্কৃতি

আসছে কিছু দেখতে থাকুন

© All rights reserved © 2021 muktokotha
Customized BY KINE IT