হারুনূর রশীদ।।
রোমান সম্রাটদের আমলে ক্রুসবিদ্ধ করে মানুষ হত্যা করা হতো? মিশরের ফারাহ’দের পর খৃষ্ট শাসনের যুগ শুরু হয়েছিল। বিশ্বের যেখানেই মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেখানেই পৌঁছেছিল খৃষ্ট ধর্ম। এই খৃষ্টধর্মী শাসকরাও বিশ্বে শাস্তির নামে আইনী হত্যা বা ক্রুসবিদ্ধ করে হত্যা রহিত করার চিন্তাই করেনি। বরং বলা যায় তাদের সময় থেকে মজবুতভাবে শাস্তির নামে হত্যা শুরু হয়েছিল। এ ছিল পুরো খৃষ্টান জগতের বিধান। কিন্তু কেনো ছিল সে হত্যা? খুব সহজ যে উত্তর, তা হলো মানুষকে ভয় দেখিয়ে শাসনে রাখা। সে সময়ের সম্রাটের শাসনের বিরুদ্ধে যারা বিরুধীতা করতো কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাদেরকে দুষমন ভাবা হতো তাদেরকে ক্রুশবিদ্ধ করে শাস্তি দেয়া হতো খোলা ময়দানে মানুষের সামনে। সাধারণ মানুষকে ডেকে আনা হতো শাস্তি উপভোগ করার নামে শাসকদের ভয়ঙ্কর নির্দয়তা দেখানোর জন্য। তারা মনে করতো এতে করে তারা মানুষকে শাসনে রাখতে পারবে কিংবা ভয় দেখিয়ে মানুষকে জয় করবে! যাদেরকে শাস্তি দেয়া হতো তাদের অবশ্য একেবারেই নিরীহ সাধারণ মানুষ বলা যায় না। ক্রুসবিদ্ধ করে হত্যা করা হতো যাদের, তারাও কোন না কোনভাবে ক্ষমতাধর মানুষ ছিল। কিন্তু আসলেই কি তারা মানুষকে শাসনে রাখতে সক্ষম হয়েছিল?
এ নিয়ে ইতিহাস পড়ুয়া ও প্রত্নতত্ত্ব বিদ্যায় পারদর্শী জন বারট্রাম লিখেছেন খুব গভীর উপলব্দি থেকে। তিনি, অমানবিক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এসব মানুষকে আজকের দিনের বিবেচনায় দূষ্কৃতিকারী বলতে চান না। তার ভাষায় মানুষেরই তো ভুল হয়। ভুল কোথায় নেই।
তিনি আধুনিক দুনিয়ার সভ্য খৃষ্টান জগতের উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন, রাষ্ট্র কর্তৃক মানুষকে হত্যা আজও খুবই স্বাভাবিক ও ভাল কাজ বলেই দেখা হয়। আধুনিক বৃটেনের উদাহরণ টেনে এনে তিনি লিখেছেন, একটি সভ্য দেশ হিসেবে বৃটেনের কথাই যদি ধরা যায় তা’হলে আজ থেকে ১৫১বছর আগে ১৮৬৮সালে বৃটেন সর্বশেষ খোলা ময়দানে হত্যা করে শাস্তি কার্যকর করেছিল। আবার এ বছরই খোলা ময়দানে হ্ত্যা শাস্তি রহিত করা হয়েছিল। এ চিন্তা থেকে আমরা, হাজার হাজার বছর আগে রোমান ব্যবস্থার ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার বিরুদ্ধে খুব একটা বড় গলায় কিছু বলতে পারি বলে মনে করিনা। এ ছাড়াও রোমানদের ওই ক্রুশদিয়ে হত্যার নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণও খুবই কম এবং দূষ্প্রাপ্যও বটে। সে সময়ের জন্য বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক ছিল। ছিল ধূলা-বালির মতই সাধারণ সত্য।
অমানবিক এসব হত্যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বারট্রাম আরো লিখেছেন, বহুমাত্রিক অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এ শাস্তি দেয়া হতো। মূলতঃ সে সময় ছিল দাস প্রথার যুগ। গোলাম হিসেবে মানুষ বেচা-কেনা হতো। গোলামীর জিঞ্জিরে বাঁধা এসব মানুষ ভুলক্রমেও যদি মালিকের আদেশ-নির্দেশ অমান্য করতো, তাকে বিশ্বাসঘাতক ধরে নিয়ে এ শাস্তি দেয়া হতো।
হ্যাঁ, এভাবেই হত্যা করা হতো এটাই ইতিহাসখ্যাত। সাধারণ মানুষের সামনে নিষ্ঠুর ও ভয়াবহভাবে হত্যা করা হতো, তাদের ভাষায় দূষ্কৃতিকারীদের যাতে কোন কালেই কেনা গোলামরা, বিরুদ্ধমত পোষণ করতে, বিদ্রোহ করতে বা চুরি করতে সাহসী না হয়।
এখানে একটি কথা বলতেই হয়, হত্যার বিরুদ্ধে সভ্য মানবসমাজ খুব বড় গলায় কিছু বলতে না পারলেও তার অর্থ এই নয় যে ক্রুশবিদ্ধকরে হত্যা হয়নি। হয়েছিল এবং আইন দিয়ে, কানুন দিয়ে মানুষ হত্যা ওখান থেকেই বেগবান হয়েছিল। যা আজও বিভিন্ন দেশে অব্যাহত আছে।
কিন্তু তাই বলে কি, বিরুদ্ধ মত পোষণ নিশ্চিন্ন হয়েছে? চুরি, ডাকাতি কিংবা অন্যান্য কাজ যেগুলোকে আমরা অপরাধ ধরে নেই; সেগুলো কি নিশ্চিন্ন হয়েছে? উত্তর একটিই, না! হয়নি কিছুই। বরং সবকিছুই উত্তরোত্তর বেসামালভাবে বেড়েছে! শুধুই কি বেড়েছে? মাত্রাতিরিক্তভাবে ভয়ঙ্কর রূপে বেড়েছে। অবস্থায় মনে হয় এসবকিছু এখন সভ্য সমাজের গা সওয়া হয়ে গেছে। নিউজিল্যাণ্ডের মসজিদে দিনে-দুপুরে খোলা বন্দুক হাতে মাথায় ক্যামেরা বেঁধে মানুষ হত্যার ভয়ঙ্কর সে রূপের বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু আছে বলে মনে করি না। নিউজিল্যাণ্ড মসজিদে মানব হত্যার ভয়ঙ্কর নারকীয় সে রূপ মানব সভ্যতার ইতিহাসে চরম কলঙ্কজনক এক পর্ব হয়ে থাকবে অনাদি অনন্তকাল।
এজন্যইতো জ্ঞানী-গুণীজন বলেছেন, শুধু অঙ্গুলি হেলনে হয় না শাসন যদি না থাকে ভালবাসা। ভালবাসা দিয়ে জয় করে নেয়ার উপরে আর কিছুই হতে পারেনা। হয় না। বিশ্বে সে উদাহরণও আছে। খুব প্রাসঙ্গিক না হলেও ভালবাসা দিয়ে শাসনের নজরুলের সেই কবিতার দুটো লাইন এখানে উল্লেখ করতে মন চাইছে।
“অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি
খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে।… পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক’ নুয়ে,”