বিগত দু’তিন সপ্তাহ ধরেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখছি নতুন করে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনা। নিপীড়ন বললে ভুল হবে, ‘হত্যাযজ্ঞ’ বললে কিছুটা সত্য বলা হবে। ব্রহ্মদেশ, অনেক পুরোনো বৈদিক যুগের নাম। আধুনিক নাম মায়ানমার। এই মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগুষ্ঠীর উপর চলছে অমানবিক নির্যাতন যা’কে পরিণতিতে হত্যাযজ্ঞই বলতে হয়।
ব্রহ্মদেশের কে একজন সামরিক কর্তা বলেছেন রাখাইন রাজ্যে যা হচ্ছে তা হলো ‘জঞ্জালমুক্ত অভিযান’, তার নিজের ভাষায়- “Clearing Operation”.
আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ও নোবেল জয়ী অং সান সু কি বলেছেন, এটি সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীগন বলছেন, যারা এ মাটির মানুষ নয় তাদের থেকে এটি আত্মরক্ষামূলক কর্মকান্ড!
এ সবগুলি কথার বিপরীতে আরেকটি কথা যা বিশ্ব বিবেক বা মানব মনোজগতের গভীরে যে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে তা’হলো- “একি গণহত্যা নয়?”! প্রথা অনুসারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে আমরা যাদের বুঝি তারা অবশ্য আজো এক হয়ে মুখ ফুটে কিছু বলছেন না যে মায়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে কি করছে! তারা ইতস্ততঃ বোধ করছেন। তারা জানতে চাচ্ছেন না “Clearing Operation” বলতে মায়ানমার সরকার কি বুঝাচ্ছে বা করছে! সত্যিকার অর্থে মায়ানমার কি চাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউ তাদের কাছে এমন কিছু জানতে চাচ্ছেন না এখনও।
আমরা বুঝি, এখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যবসার ক্ষেত্র তেমন উর্বর নয় মনে করেই হয়তোবা তারা নাক-কান গলাতে তেমন শক্তভাবে এগিয়ে আসতে চাচ্ছেন না। রাখাইন রাজ্যের কোথায়ও তো আর গ্যাস-তেল উঠেনা। যদি উঠতো তা’হলে এতোদিনে বিশ্ব বন্ধু সাজে মার্কিন ধনবাদ রাখাইন রাজ্যে ঘাঁটী বসিয়ে দিতেন। আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলে কত প্রস্তাব যে পাশ হতো তা গুনে শেষ করা যেতো না।
ব্রহ্মদেশ রীতিমত রাখাইন রাজ্যে নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মত কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম রাখাইন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে লুকিয়ে ও প্রকাশ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রতিদিনই ডজন ডজন লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এর পর এ অবস্থাকে কি বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সে ভাষা আমাদের জানা নেই।
“আরব নিউজ”এ ওবাই শাহবান্দার(Oubai Shahbandar) নামের একজন কলাম লেখক লিখেছেন মায়ানমার সরকার খুব চালাকি করে আসল ঘটনাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তারা রীতিমত সেখানে হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে এবং রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রামে আগুন লাগিয়ে বাড়ী-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে।
মায়ানমার সরকার মিথ্যাভাবে দুনিয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সরকারের সাথে মিলে মারাত্মক অপরাধমূলক সন্ত্রাসবাদ দমনে কাজ করে যাচ্ছে! তারা পরিকল্পিতভাবে তাদের হ্ত্যাযজ্ঞের ফলে সৃষ্ট সর্বনাশা মানবিক বিপর্যয়কে অস্বীকার করে যাচ্ছে। যেখানে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাদের বাড়ী-ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।
হতেই পারে, রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু তাই বলে একটি অঞ্চলের সংখ্যালঘু মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে! মায়ানমার সরকার সন্ত্রাস দমনের ন্যায্যতার যে পাতলা আবরণ ব্যবহার করছেন তা কিন্তু ‘গণহত্যা’ থেকে খুব দূরের কিছু নয়। আর এ বিষয়টি বুঝতে কাউকে ‘ডক্টরেট’ নিতে হয় না।
এ অবস্থায়, এখানে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি যে একটি শক্তি খুবই পরিকল্পিতভাবে এই অঞ্চলের স্থিতি বিনষ্ট করে এখানে সন্ত্রাসের আইনানুগ দমনে না গিয়ে নতুন করে সিরিয়া আফগানিস্তানের মত দীর্ঘমেয়াদী একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরী করতে আগ্রহী যা কোন ভাবেই আমাদের স্থিতিকে সংহত করতে সহায়ক নয় বলেই আমরা মনে করি। সবশেষে শুনা একটি আশার কথা যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মঙ্গলবার মায়ানমার যাবেন। সারা দুনিয়ার মত আমরাও আশা করছি মোদী সর্বজন গ্রহনযোগ্য একটি সুখকর বারতা নিয়ে ফিরবেন।
লন্ডন, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭