লন্ডন: যাদের হাত ধরে জঙ্গিবাদের বিস্তার এদেশে, তাদেরই একজন মুফতি আব্দুল হান্নান। শুরুতে পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদিনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশে (হুজি-বি) যোগ দিয়ে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা বনে যান। তার নেতৃত্বে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৭টি হামলা চালানো হয়। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন ১০১ জন, আহত হয়েছেন ৬০৯ জন। এর মধ্যে একটি হামলা ও দুইটি হামলা চেষ্টার ঘটনার মূল টার্গেট ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুফতি হান্নান প্রকাশ্যে আসেন ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর। র্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ (পিলখানায় নিহত) ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার আনন্দনগরের ভাড়া বাসা থেকে মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করেন।
মুফতি হান্নানের পরিচয়
মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রামের মৃত নূর উদ্দিন মুন্সির ছেলে। মুসলিম লীগ নেতা নূর উদ্দিন মুন্সি মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। নূর উদ্দিন মুন্সির ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে মুফতি হান্নান দ্বিতীয়। মুফতি হান্নান ২ ছেলে ২ মেয়ের জনক।
পড়াশুনা
মুফতি হান্নানের পড়াশুনা শুরু গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও বরিশালের শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায়। এরপর ভর্তি হন ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরের বছর ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানে যান এবং ভর্তি হন করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নূরিয়া মাদ্রাসায়। আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ১৯৯৩ সালের দিকে দেশে ফিরে ব্যবসা-বণিজ্য শুরু করেন। গোপালগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরীতে সোনার বাংলা সাবান ফ্যাক্টরি গড়ে তোলেন। দেশে ফেরার পরপরই পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়ে তত্পরতা শুরু করেন। অবশ্য এর আগেই আফগান ফেরত এদেশীয় মুজাহিদরা হুজি-বি গঠন করেন। মুফতি হান্নান ১৯৯৪ সালে হুজি-বিতে যোগ দেন।
যশোরে উদীচীর হামলা দিয়ে শুরু
১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কবি শামসুর রাহমানকে হত্যাচেষ্টার মধ্য দিয়ে জঙ্গি হামলা শুরু করে হরকাতুল জিহাদ। ৬ মার্চ বোমা হামলা চালানো হয় যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও আহত হন দেড়শ জন। যদিও তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ ঘটনায় বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ফলে জঙ্গিদের বিষয়টি তখন আড়ালেই থেকে যায়। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা হয়। তাতে ৮ জন নিহত হন।
২০০০ সালের ১৩ জুলাই ফরিদপুরে এক পীরের মাহফিলে বোমা বিস্ফোরণের অন্যতম হোতাও ছিলেন হান্নান। এতে ১ জন নিহত ও ৭ জন আহত হন। ২০০০ সালের ২২ জুলাই কোটালীপাড়ায় তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছাকাছি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে প্রথম আলোচনায় আসেন মুফতি হান্নান ও তার দল। এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে থেকে তত্পরতা চালান। পরবর্তীতে ২০০১ সালে ২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে সিপিবির সমাবেশে, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ ৬টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন হান্নান; কিন্তু ২৭ মে হান্নানের সহযোগীরা গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। একই বছরের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। এই হামলারও নির্দেশ দেন হান্নান। ওই বছরের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণে ২০ জন নিহত হন। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে আরো একদফা শেখ হাসিনাকে বোমা মেরে হত্যার পরিকল্পনা করেন হান্নান। তবে অসতর্ক অবস্থায় নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয় ২ জঙ্গি। ২০০৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে অপহূত হন হোমিও চিকিত্সক আব্দুল আজিজ। পরে হান্নানের নির্দেশে গাজীপুরের পোড়াবাড়ি এলাকায় হত্যা করা হয় তাকে।
২০০১ সালের ৩ জুন গোপালগঞ্জে বানিয়াচং গীর্জায় বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে হান্নানের সহযোগীরা। একই বছরের ২১ জুন সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমাবেশে বোমা হামলার হোতাও হান্নান। এতে ১ জন নিহত আর অর্ধশত আহত হন।
এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে। এতে আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দুই শতাধিক ব্যক্তি। তবে এ ঘটনার আগে ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে বাংলাদেশে তত্কালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর এবং ৭ আগস্ট সিলেটের তত্কালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বির জঙ্গিরা। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর সিলেটে আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা জেবুন্নেছা হকের বাসায় হামলা চালায় হান্নানের সহযোগীরা। -ইত্তেফাক থেকে