শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে আন্দোলনের সূচনার জন্য হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের অমর সৃষ্টি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসক আর যুদ্ধাপরাধীদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ঠিক সেই সময় আলোর দিশারির ভূমিকা পালন করেছেন কথা সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধায় এই মহীয়সী নারীকে স্মরণ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাইফ ইমাম জামী মার কথা বলতে গিয়ে বার বার আবেগাফ্লুত হয়ে পরেন। তিনি বলেন, আমি যখন আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আর কত করবে, তখন আম্মা আমাকে বললেন, ‘গোলাম আজমকে জামায়েতের আমির করা হয়েছে, এইটা নিয়ে আমি বেচে থাকতে পারি না, এঁর প্রতিবাদ আমাকে করতেই হবে’। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছুটে গিয়েছিলেন। সাইফ ইমাম জামি কান্না জড়িত কণ্ঠে শহীদ জননীর শেষ সময়ে প্রবাসীদের সাহায্য সহযোগিতার কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং মায়ের সেই আন্দোলনকে আজও এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের প্রতি, কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহরিয়ার কবির এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কাজি মুকুলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, শহীদ জননীর লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং তিনি যখন পড়ান তখন খুব আবেগাফ্লুত হন, কারণ শহীদ জননীর সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের কারণেই তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। তিনি যে একজন শুদ্ধাচার মানুষ ছিলেন, তা তিনি রেখে গেছেন আমাদের মধ্যে। কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কাজি মুকুল বলেন শহীদ জননী মানুষের হৃদয়ে বেচে থাকবেন দুটি কারণে, তার একটি হল বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হাড়িয়ে যেতে বসেছিল, ঠিক সেই সময় তিনি মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন, আর অন্যটি হল তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি লিখার জন্য। বাংলাদেশের আমজনতাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে শহীদ জননীকে নিয়ে আরও স্মৃতিচারণ করেন ডঃ জিনাত নবী এবং শহীদ জননীকে নিয়ে স্মরচিত কবিতা পাঠ করেন শহীদের সন্তান কবি হাসান আল আব্দুল্লাহ।
ড. নুরুন নবী নিজের লেখা বই ‘জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি’ থেকে শহীদ জননীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন জাহানারা খালাম্মাকে যখন শেষ বারের মত মিশিগানের এক হাসপাতালে দেখতে যাই, তিনি কাগজে লিখে দেশের কথা জিজ্ঞেস করলেন, আন্দোলনের কথা জানতে চাইলেন। মৃত্যুর পরে তার অবর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন দেশবাসীর উপর অর্পণ করার কথা জানালেন শহীদ জননী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কেন্দ্রীয় সভাপতি লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির এই আন্দোলনে আমাদের শত শত কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে বিএনপি জামায়েত জোট সরকারের হাতে। কিন্তু আন্দোলন কখনো থেমে থাকেনি। আজ যদিও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে আমরা সম্পূর্ণভাবে ফিরে যেতে পারিনি। ধর্মীয় রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারলেই আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
সর্বশেষে সংগঠনের সভাপতি ফাহিম রেজা নূর বলেন শহীদ জননী যে মশাল জ্বালিয়েছিলেন সেই মশাল আমরা আজও বহন করে চলেছি, ধৈর্য হারা না হয়ে আমাদের পথ চলতে হবে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্ব যে পথ দেখাচ্ছে সেই পথ ধরেই নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক করতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।।
|