কূটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক আহমদ চৌধুরী (৮৪) আর নেই। আজ বুধবার ১৭ মে ভোর সাড়ে ৪ টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, (ইন্না লিল্লাহি…রাজিউন)।
আজ বাদ আসর ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের বাইতুল আমান জামে মসজিদে ফারুক আহমেদ চৌধুরীর জানাজা হবে। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁর মরদেহ নেওয়া হবে। সেখানেও তাঁর জানাজা হওয়ার কথা।
অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী কূটনীতিক ফারুক আহমদ চৌধুরী। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভাষা ও আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নির্ধারণে তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি দেখেছেন ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তানের জন্ম, এর বিলয় এবং নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান।
ফারুক চৌধুরীর জন্ম বৃটিশ-ভারতীয় শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জে, ১৯৩৪ সালের ১৪ জানুয়ারি। মা রফিকুন্নেছা খাতুন চৌধুরী। বাবা গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ছিলেন সরকারি চাকুরে, ম্যাজিস্ট্রেট বাবার প্রথম সন্তান ফারুক চৌধুরী, এরপর আরও ৫ সন্তানের জন্ম হয় গিয়াসুদ্দিন চৌধুরী দম্পতির। যাঁদের প্রায় সবাই পরবর্তী সময়ে খ্যাতিমান-সফল। এর সঙ্গে নিজেদের মধ্যে ভালোবাসাটুকু আছে সবসময়। অপ্রত্যাশিত পিতৃবিয়োগ এবং পরবর্তী সময়ে মাতাকে হারানোর বেদনা এখনো বোধ করেন গভীরভাবে। সেই হারিয়ে যাওয়া পরিবার নিয়ে শোনা যাক ফারুক চৌধুরীর নিজের মুখেই, ‘আমরা চার ভাই আর দুই বোন। আমার তিন ভাই—ইনাম, মাসুম আর ইফতেখার। দুই বোন—নাসিমা আর নীনা। আমাদের মাঝে মাসুম বেঁচে নেই। ওয়াশিংটনে, যেখানে তার দুই সন্তানের বাস, সেখানেই সে চিরনিদ্রায় শায়িত। পাকিস্তানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সে তার সরকারি কর্মজীবনের ইতি টেনেছিল। অবসরপ্রাপ্ত সচিব, বিএনপি সভাপতির উপদেষ্টা, ইনাম এখন দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখার এখন সিঙ্গাপুরে অধ্যাপনারত। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল সৈয়দ আবদুল হাইয়ের বিধবা স্ত্রী নাসিমা স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করছে। নীনা এবং তার স্বামী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ওয়াশিংটনে আছেন। বাবা সরকারি চাকুরে, ফলে বদলি অবধারিত একটি ব্যাপার। এর সঙ্গে আরেকটি অবধারিত ব্যাপার ছিল, তা হলো স্কুল বদল।’
ফারুক চৌধুরী ১৯৪১ সালে ভর্তি হন সুনামগঞ্জ জুবেলি স্কুলে, এরপর ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত, এই আট বছরে বদলাতে হয়েছে ৮টি স্কুল। তবে স্কুল বদল ঘটলেও পড়াশোনায় ব্যত্যয় ঘটেনি। মাধ্যমিক শেষ করে চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ১৯৫২ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি সাহিত্যে।
চাকরিতে যোগ দিলেন ১৯৫৬ সালে, ফরেন সার্ভিস-এ। যোগ দেয়ার জন্য করাচি গমনের মাধ্যমে এই যে শুরু, তারপর তাঁকে নানা দেশে যেতে হয়েছে, পালন করেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। চাকরিজীবন শেষ করেন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে। ছিলেন ভারত এবং পাকিস্তানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি। ওআইসি এবং সার্ক প্রথম সম্মেলনের সমন্বয় ছাড়াও তিনি জাতিসংঘ এবং অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান ১৯৯২ সালে, এরপর তিনি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত হন। আজ অবধি এ যুক্ততা অব্যাহত আছে।
চাকরিসূত্রে ঘুরেছেন যেমন নানা দেশ, তেমন দেখা হয়েছে নানা রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে, সান্নিধ্য পেয়েছেন খ্যাতিমান মানুষের। এর মধ্যে রযেছেন—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রনায়ক ইয়াসির আরাফাত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী (১৯৮৭), চীনের প্রেসিডেন্ট ওয়েন জিয়াবাওয়ে (২০০৩), ভুটানের রাজা জিমে খেসার ওয়াংচুক, চীনের সর্বশেষ সম্রাট পু ই, বক্সার মোহাম্মদ আলী, আণবিক বিজ্ঞানী কাদির খান—এমন আরো অনেক নাম। তবে তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিশেষভাবে স্মরণীয়। একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং দূরদর্শী কূটনীতিক বোধ ছিল তাঁর, যা নতুন একটি দেশকে বিশ্ব দরবারে গ্রহণীয় হতে সহায়তা করেছিল। ইত্তেফাক থেকে ইশৎ সম্পাদিত।