-শামসুল হোসেন চৌধুরী শাম্মী
আসিফ সাহেব পাসপোর্ট অফিসে যাইবেন বলিয়া তড়িঘড়ি করিয়া কাপড়ে চোপড়ে ভদ্রস্ত হইয়া দুয়ার মুখো হইয়াছেন, তক্ষনি দোর ঘন্টা বাজিয়া উঠিল। ঘন্টাটির আওয়াজ অত্যন্ত কর্কশ ও তেজি। ক্ষনিক সময় ধরিয়া খে খে খে করিয়া বাজিয়া চলে যা মেজাজ তিরিক্ষি করিবার জন্য যথেষ্ট। ঘন্টাটি নষ্ট হইলে তিনি একটি সুরেলা শব্দের ঘন্টা লাগাইবেন বলিয়া স্থির করিয়াছেন তাহাও বহু বৎসর হইল কিন্তু আজ অবধি তাহা নষ্ট হইলনা। নষ্ট হইবে ফ্রিজ, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি যাহাতে আধুনিক জীবন থামিয়া যায়, ভর্তুকি গুনিতে হয় অনেক বেশী। কিন্ত এই ক্ষুদ্র যন্ত্রটি যা থাকিলে চলে, না থাকিলেও চলে, মূল্যও নিতান্তই কম তাহার কর্ম সম্পাদনের বিশ্বস্ততায় এ যাবত কোন ব্যত্যয় ঘটিল না; তাই অন্য সব অপ্রিয় শব্দের সহিত এই ‘ খে, খে খে’ ধ্বনি তাঁর জীবনের সহিত গাঁথা হইয়া রহিয়া গেল।
আজ তাঁহার মন মেজাজ ভাল নাই, পাসপোর্ট নবায়ন করিতে হইবে, ঐ অফিসের ঝক্কি ঝামেলা যে কত প্রকার তাহা তিনি জানেন, ভীড়, লাইনে ঠেলা ঠেলি কে আগে কে পরে। অবশেষে নির্দিষ্ট টেবিলে পৌছিলে হয়তো শোনা যাইবে ওমুক কাগজটা সত্যায়িত করিয়া আনুন, এই ফর্মটাতে হইবেনা ঐ ফর্মটা পুরন করিয়া আনুন, ব্যাংকের রশিদটা ফর্মের সাথে আঠা দিয়া লাগাইয়া আনুন। ব্যাস! আপনি বাহির হইয়া আসুন ঐসব কর্ম সম্পাদন করিয়া ‘সাপ লুডু’ খেলার ছক্কার মত আবার লাইনের লেজে দাঁড়াইয়া পড়ুন, সাথে সাথে সাপলুডু খেলায় অংশ গ্রহন করিতেছেন ভাবিয়া আনন্দিতও হইতে পারেন তাহাতে অবশ্য কেহই বাঁধা দিবে না।
এখানেই শেষ নহে, ইহা এক্কা দোক্কা খেলার প্রথম ধাপ মাত্র। এই পর্বে বলা হইবে অত নম্বর কক্ষে যান সেখান হইতে সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া আরেক কক্ষ এই ভাবে ৪/৫ টি কক্ষ প্রতিটি ছোট বড় লাইন বাহিয়া পাড়ি দিতে হইবে। কপাল মন্দ হইলে দশ তলা পর্যন্ত আরোহনের ভাগ্য যোগ হইবে, না হইলে তাহার পূর্বেই পাপমোচন পত্র হাতে আসিবে। তাহাতে নাম ধাম সহ tentative delivery date দেওয়া থাকে। পত্রটি হাতে লইয়া তাহাতে চোখ বুলাইয়া দেখিবেন, সুবিশাল এক কর্ম সম্পাদনের প্রশান্তি আপনার দেহ মনে ছডাইয়া পড়িতেছে, ইহাকে উপরি পাওয়া বিবেচনা করিলে ঘটিয়া যাওয়া সকল কায় ক্লেশ আপনা হইতেই বিদুরিত হইবে।
এসকল কথা মনে হইতেই আসিফ সাহেবের ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল যেন। এই সব কর্ম তাহাকে করিতে হইবে বলিয়া তিনি মানসিক প্রস্তুতি লইয়াছেন। অধিক কাল দাঁড়াইয়া থাকার শারিরীক সক্ষমতাও পরখ করিয়াছেন। আর তাহা করিতে যাইয়া গত রাত্রে তাঁহার ভাল ঘুম হয় নাই, তাঁহার কেবলই মনে হইতেছিল এই পাঁচটা বৎসর এত দ্রুত চলিয়া গেল কি করিয়া? একটু ধীর লয়ে গেলে তিনি আরোও কতকটা সময় পাইতেন পাসপোর্টটা নবায়নের জন্য। এই পাঁচ বছরে তাহারতো আরোও কতক স্থানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পার্শ্বিকতার চাপে তাহাও হইয়া উঠে নাই, যদিও তিনি একা মানুষ তদ্যপি একা নহেন বরং বলা যায় সকলের, তাই পারশ্বিকতার চাপ, চাহিদায় তাহাকে সাড়া দিতে হয়। সাড়া দিতে তিনি পছন্দও করেন তবু ভাবিলেন পাঁচ পাঁচটা বৎসর এমনিতেই গেল কোন কাজের কাজ হইল না।
তিনি সময়ের উপর রাগ করিলেন কিন্তু তাহাতে যে অগ্র পশ্চাৎ কিছু হইবার নহে তাহা তিনি জানেন। বোবা কালা সময় কোথায় চলিয়াছে না জানিয়া শুধু বহিয়াই চলে নিরন্তর। এন্তার চিন্তা ভাবনায় নির্ঘুম রজনী পাড়ি দেওয়ায় মেজাজটা তাঁহার ভাল নাই; তাহার সহিত এই খে খে খে শব্দ যোগ। মেজাজ আরোও চড়িল। এই তিরিক্ষি মেজাজ না লুকাইয়া মুখোমন্ডল স্বাভাবিক না করিয়া দুয়ার খুলিলে আগত অতিথি ভাবিবেন তাহার আগমনে গৃহ কর্তা বুঝি বেজার হইলেন, আসিফ সাহেব ইহা বোঝেন তবু আজ অত শত চিন্তা না করিয়া দুয়ার খুলিলেন। তক্ষনি তাহার রুক্ষ, শুস্ক, তপ্ত মনে শান্তি সুনামির উদ্রেক ঘটিল, বিস্ফারিত নেত্র পলক ফেলিতে কিছুটা বিলম্ব করিল, দেখিলেন তাঁহার পুরাতন এক রিটায়ার্ড বন্ধু সম্মুখে দন্ডায়োমান। তিনি খুশী হইলেন একাকী সময়ের রুক্ষতা তিরোহিত হইল।
কহিলেন – এই মোবাইলের যুগে কেহ ফোন না করিয়া আসে, তুমি এখনো সেই হাবা রহিয়া গেলা।
বন্ধুটি উত্তর করিলেন – তাহা না হইলে তোমার বন্ধু হইলাম কি করিয়া? উচ্চ হাসিতে দুজনই হাসিয়া উঠিলেন।
তিরিক্ষি মন মেজাজ হইতে আসিফ সাহেবের আপাতত নিস্কৃতি জুটিল। পাসপোর্ট অফিসে সেদিন আর যাওয়া হইল না বটে তবে বন্ধুর সহিত গাল, গল্পে, স্মৃতি চারণে দিবসটি অত্যন্ত সুন্দর কাটিল।
আনন্দ রসায়ন যোগে সময় ধরা দিক, ইহাতো সকলেরই চাওয়া।
সকলের সুন্দর সময় হোক।।