-হারুনূর রশীদ
পহেলা বৈশাখ। বাংলা দিন পঞ্জিতে বছর গণনার প্রথম দিন। ভারতীয় দিনপঞ্জিকায় বাংলা সনের আবির্ভাব আমাদের সকলেরই জানা আছে গৌড়ের রাজা শশাংকের সময় এর উদ্ভব। ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে বিজ্ঞ ও শক্তিমান সম্রাট আকবর এর পুনঃপ্রবর্তন করেন। কারণ পূর্বে চালুকৃত হিজরী দিনপঞ্জিকা চান্দ্রমাসের হওয়ার ফলে কৃষিজীবী প্রজাকূল ঋতু বহির্ভুত মাসে খাজনা পরিশোধে খুবই সমস্যার সন্মুখীন হতো। সাধারণের কাছ থেকে সহজে খাজনা আদায়ের নিমিত্তে আকবর এ ব্যাবস্থা নেন। এর পর থেকে আজ অবদি উভয় অংশের বাংগালী সম্প্রদায় এ দিনটিকে সারা বছরের ঋণকর্জ তামাদি দেনা সবকিছু উশুলের দিন হিসাবে আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে। এখন সেই বাদশাহী বা জমিদারী আমল নেই ঠিকই তাদের জায়গা পূরণ করেছে নব্য গড়ে উঠা ধনবান আর বণিক শ্রেণী যাদের মূল ভিত হলো ব্যবসা। উভয় বাংলার প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে বিশেষ করে ব্যবসায়ী সমাজ এদিনটিকে ‘হালখাতা’ অর্থাত বকেয়া তামাম ঋণ পরিশোধের দিন হিসাবে পালন করে আসছে। হাল-খাতার প্রাচীণ নিয়মের সংস্কার সাধিত হয়ে রূপ পাল্টেছে। খুবই আড়ম্বরের সাথে উতসবের আবহে দিনটিকে উপভোগ করা হয়। গ্রামে এখনও হালখাতাই রয়ে গেছে কিন্তু শহুরে জীবনে এর আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দিনটির আগমনে শহুরে জীবন যেনো নতুন উদ্দীপনায় জেগে উঠে। সর্বস্তরের মানুষ বিচিত্রসব মনোমুগ্ধকর আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে দিনটিকে পালন করতে গিয়ে এক বিশাল উতসবের রূপ দিয়েছে।
দিনপঞ্জির এই গণনা, এই যে শনি থেকে শুক্র পর্যন্ত সাত দিন, মাস কিংবা বছরের গণনা, দুনিয়ার তাবত মানব সমাজে তার প্রয়োজনীয়তা এখন শুধু অপরিহার্য্য বললে কম বলা হবে। এই দিন গণনা বাদ দিয়ে পৃথিবীর কোন মানুষ জীবন ধারণ করতে পারবে কি-না আমার সন্দেহ আছে। দুনিয়াতে দিনপঞ্জির প্রথম ব্যবহার, এর বিবর্তণ ও তার প্রণেতা কে বা কারা এ নিয়ে বিচক্ষণ গবেষণার প্রয়োজন আছে। মতান্তরও অফুরাণ রয়েছে। এই সেদিন ভেটিকানের বর্তমান পোপ বলেছেন যীশু খৃষ্টের জন্ম প্রচলিত মতের ২ থেকে ৭ বছর আগে হয়েছে। তার অর্থ দাড়াচ্ছে এই যে বিগত দু’হাজার চৌদ্দ বছর ধরে আমরা যে দিন-তারিখ গণনা করে আসছি তা সবই ভুল। পোপ শুধু তারিখ ভুল বলেই কান্ত হননি আরো বলেছেন যে যায়গায় জীশুর জন্ম বলা হয়ে আসছে সেটিও ভুল। যীশু খৃষ্টের বিষয়ে পোপের কথার পর আমাদের কিছু বলার প্রশ্নই উঠেনা। ভুল হলে সময় তা ঠিকই সংশোধন করে নেবে। আর পঞ্জিকার সংস্কার নতুন কিছু নয়। সময় ও মানুষ যা চাইবে তাই হবে।
কিন্তু সময়কে অর্থবাহী সুন্দর নাম দিয়ে সাতটি দিবসের বিভাজন এবং মাসের নাম দিয়ে বারোটি মাসের বিভাজনের মাধ্যমে মানব জীবনে যে অভূতপূর্ব কল্যাণময়ী বিপ্লবের সূচনা করা হয়েছিল যা অনাদি অনন্তকাল পর্যন্ত টিকে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস, তার সঠিক ইতিহাস কার না জানার ইচ্ছা হয়। জোতির্বিজ্ঞানীগন নিশ্চয়ই নির্ভুল করে বলতে পারবেন। আমার জানামতে পৃথিবীতে ৩টি রীতির- চন্দ্র-সূর্য্য মাস মিলিত পদ্বতি, চন্দ্রমাস পদ্বতি ও সৌরমাস পদ্বতির মোট তেত্রিশটি পঞ্জিকা কার্যকর আছে বা মানুষ ব্যবহার করছে। সময়ের এই বিভাজন কে কখন কোথায় প্রথম করেছেন এ সম্পর্কে মানুষের সংগ্রহে যা আছে তাতে দেখা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীণতম পঞ্জিকা গণনা করতে গিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে ৭৫২৩ সংখ্যাগুলি। এই গণনার শুরু বলা হয়েছে ৭৫৩ খৃষ্টপূর্ব সনে। প্রাচীণ গ্রীস থেকে এর শুরু। বাইজেনটাইন ক্যালেন্ডার হিসাবেই ইহা বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিল। রোমের প্রতিষ্ঠাতা রুমুলাসের নামে রুমান ক্যালেন্ডার হিসেবে এর সূচনা। ঐ ক্যালেন্ডারে মাসের সংখ্যা ছিল ১০টি । প্রথম মাসের নাম ছিল মেরিথিয়াস ৩১দিন, এপ্রিলিস ৩০, মাইয়াস ৩১, লুনিয়াস ৩০, কুইনটিলিস ৩১, সেক্সটিলিস ৩০, সেপ্টেম্বর ৩০, অক্টোবর ৩১, নভেম্বর ৩০ আর ডিসেম্বর ৩০দিন। সময়ের অনেক পথ হেটে পোপ গ্রেগরী-৮ এর সময় অর্থাত ১৫৭৬খৃঃ অব্দে তত্ত্তকালীন রোমের পেরুসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধি বিভাগের অধ্যাপক ওলয়সিয়াস লিলিয়াস, পোপের কাছে দিনপঞ্জিকার যে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেন তাহাই গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার বলে পরিচিত। আরো শতাধিক বর্ষ পরে ১৭৩২ খৃঃ ওয়ালটার কারদেউ নামক অপর একজন আরো সংস্কার করেন। ইংলিশ দিনপঞ্জিকার বর্তমান রূপ তারই দেয়া।
এর পর আসে হিব্রু ক্যালেন্ডার, গণনা দেখাতে গিয়ে ব্যবহার করা হয় ৫৭৭৪ এই অংকগুলি। এর পর হলো মহাভারতীয় গণনা, দেখানো হয় ৫১১৫ সংখ্যাগুলো দিয়ে। অনেকেই ভারতীয় সৌরপঞ্জিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীণ পঞ্জিকাসৃষ্টি বলে মনে করেন। প্রাচীণ ভারতীয় গ্রন্থ লগদ’এর ‘বেদাঙ্ক জোতিষ’কে প্রাচীণতম পুস্তক বলে ভারতীয় বিশেষজ্ঞগন মত প্রকাশ করেন। বৈদিক যুগের ভারতীয় পন্ডিতগন সময়কে দন্ড, মূহুর্ত, তিথি, পক্ষ, মাস, ঋতু কিংবা বছর এই নামাঙ্কিত করে যে ভাগ করে গেছেন তা আজ অবদি নির্ভুলভাবে ব্যবহার্য্য।