আমার শহরে কোন সম্রাট নেই, রাজা নেই, কিন্তু শক্তির মত অনেক পাপহীন, শুভ্রমানুষ আছে। এই মানুষেরাই আমাদের নিত্যজীবনের ছোট্ট ছোট্ট ঝর্ণাধারা ছিল, টলমলে জলের দিঘী ছিল, বনফুলের সুবাস ছিল।
শক্তি শিকদার মানিকগঞ্জ শহরের কোন রাজনীতিক ছিল না, শিল্পী ছিল না, খেলোয়াড় ছিল না, অভিনেতা কিংবা কবিও ছিল না কিন্তু মানসিক বিকাশের অক্ষমতা, অপূর্ণতা নিয়ে জন্মানো শক্তি শিকদার একান্তই আমাদের ছিল। শহরের শহীদ রফিক সড়ক, গার্লসস্কুল রোড, কালীবাড়ি মোড়, উত্তরাব্যাংক মোড়, রিজার্ভট্যাংক এলাকাই ছিল শক্তির পৃথিবী।
সকাল থেকে মধ্যরাত, শহরে যতদিন এসেছি, ঘুরেছি, বেরিয়েছি শক্তির সাথে দেখা হয়নি, মজা করিনি এমন দিন ছিল বিরল। আমার নাম কোনদিন উচ্চারণ করেনি, হয়তো উচ্চারণ করতে পারতো না। আমাকে সুর করে ডাকতো “ওই! ওইই” বলে। দেখা হলেই তার আন্তরিক আব্দার ছিল ৫ নয়তো ১০ টাকার। এমন আব্দারের মানুষও ছিল তার হাতে গোনা। এই টাকায় কোনদিন কোন কিছু কিনেনি। কিনতো কেবল বিড়ি, নয়তো সস্তা সিগারেট।
শক্তির সাথে বহুদিন রসিকতাও করেছি প্রাণভরে। শক্তি হাসতে জানতো। বুঝতোও অনেক কিছু। শহরে যেদিন র্যাব, পুলিশ, আর্মির টহল গাড়ি চক্কর দিয়েছে শক্তি সেদিন অস্থির থাকতো, চেনা মানুষ, কাছের মানুষকে দেখলেই হইচই করে ডাকতো, আর বলতো “ব্যাব, ব্যাব” “পুলিত” বাড়ি যা, বাড়ি যা। শক্তি র্যাবও বলতে পারতো না, আর্মিও না। এমনও দিন গেছে আর্মির গাড়ি দেখে হাত ধরে জোর করে টেনে মেইনরোড থেকে সাইড রোডে নিয়ে গেছে।
আমরা বুঝতাম এ ছিল আমাদের জন্য শক্তির পবিত্র ভালবাসা।
দুষ্টু ছেলেরা, কখনও বয়ষ্করা হাতে একটা কাগজ-কলম নিয়ে শক্তির চারপাশে ঘুরে টিপসই চেয়ে শক্তিকে ক্ষেপাতো, মজা করতো।
এই শহরে শক্তিদের ৫ তলা ভবনসহ প্রচুর সম্পত্তি আছে। শক্তির ভয় ছিল টিপ নিয়ে যদি সম্পত্তি নিয়ে নেয়। অথচ শক্তির কাছে সে সম্পদের কোন মূল্য ছিল না, শক্তি তা ছুঁয়েও দেখেনি, কাজেও লাগেনি কোন দিন।
শক্তির বাবা কালীদাস দা এই শহরের সবচেয়ে প্রবীন আর্টিস্ট ছিলেন।
ব্যানার, সাইনবোর্ড লিখতেন, ছবি আঁকতেন। তার আর্টফার্মের নাম ছিল “মালঞ্চ”। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে, মফস্বল শহরের সাইনবোর্ড, ব্যানার লেখার কোন দোকানের নাম মালঞ্চ হতে পারে এটা ভাবতেই কেমন অবাক লাগে।
এই শহর থেকে প্রতিদিন কেউ না কেউ চলে যান। অনেক বড়মাপের মানুষেরা চলে গেলেও বুকের ভিতরে তাদের সবার জন্য শূন্যতার বীণা কখনোই গভীরভাবে বাজে না, কষ্টও টের পাইনা অনেকের ক্ষেত্রে। কিন্তু শক্তি শিকদাররা চলে গেলে শহরটা ফাঁকা মনে হয়, ভিতরটা হুহু করে কাঁদে।
আমাদের শক্তি গত পরশু ৪৩ বছরের জীবন বাতি নিভিয়ে, এই শহর, ইহলোক ছেড়ে স্বর্গবাসী হয়েছে।
সোমাবার ৮ই জুলাই ২০১৯
|