মুক্তকথা: লন্ডন, বৃহস্পতিবার, ১৫ই কার্তিক ১৪২৩, ১০ই নভেম্বর ২০১৬।। নূর হোসেন, একটি নামই শুধু নয় একটি আন্দোলনের নামও বটে। নূরহোসেন ‘৫২ থেক ‘৭১ অবদি আমাদের আন্দোলন সংগ্রামে আত্মাহুতি দেয়া সাহসী দেশপ্রেমিকদের গর্বিত উত্তরসূরি, আমাদের সংগ্রামী চেতনারই আরেক নাম যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে স্মরণীয় নাম। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন।
নূর হোসেনের জন্ম ১৯৬১ সালে। তার পৈতৃক বাড়ি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তার পরিবার স্থান পরিবর্তন করে ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে আসে। পিতা মুজিবুর রহমান ছিলেন পেশায় অটো-রিকশা চালক। তাঁর মায়ের নাম মরিয়ম বিবি। অথর্নৈতিক অসচ্ছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর নূর হোসেন পড়াশোনা বন্ধ করে মোটর চালক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নূর হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার পাব্লিসিটি সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন।
স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের লক্ষ্যে দেশের তৎকালীন শক্তিশালী দু’টি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একজোটে, ১৯৮৭ সালের আজকের এই দিনে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করে। এর কয়েক বছর আগে, এরশাদ ১৯৮২ সালে একটি সেনা উত্থানের মধ্যদিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে জয়্লাভ করেন। সেই সময়ের বিরোধী দলগুলো তার এই নির্বাচনকে জালিয়াতি বলে অভিযুক্ত করে। ফলে ঘোষিত হয় ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী। অবরোধ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ঢাকায় একটি মিছিলে নূর হোসেন অংশ নেন এবং প্রতিবাদ হিসেবে বুকে পিঠে সাদা রঙে লিখিয়ে নেনঃ ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ । মিছিলটি ঢাকা জিপিও-র সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি আসলে স্বৈরশাসকের পুলিশবাহিনীর গুলিতে নূর হোসেনসহ মোট তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন, এসময় বহু আন্দোলনকারী আহত হন। নিহত অপর দুই ব্যাক্তি হলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হূদা বাবুল এবং আমিনুল হূদা টিটু।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে বিক্ষোভে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যায়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ই নভেম্বরের স্মৃতিচারন করে বলেছিলেন,
সেদিন আমরা যখন মিছিল শুরু করছিলাম তখন নূর হোসেন আমার পাশে দাড়িয়ে ছিল। আমি তাকে কাছে ডাকলাম এবং বললাম তার গায়ের এই লেখাগুলোর কারনে তাকে পুলিশ গুলি করবে। তখন সে তার মাথা আমার গাড়ির জানালার কাছে এনে বলল, “আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।”
নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতি বছরের ১০ই নভেম্বর বাংলাদেশে নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এছাড়া তিনি যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তার নামানুসারে সেই জিরো পয়েন্টের নামকরন করা হয়েছে নূর হোসেন স্কয়ার।
১০ই নভেম্বর তার মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তোলা তার গায়ে লেখাযুক্ত আন্দোলনরত অবস্থার ছবিটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক গুরুত্ব ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নূর হোসেন আত্মাহুতি দিয়ে অজানা দেশে চলে গিয়েছেন ঠিকই তবে এদেশের সাধারণ মানুষের মনে তিনি জেগে আছেন এবং থাকবেন যতদিন বাংলাদেশ নামের দেশটি মানচিত্রে বেঁচে থাকবে।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, http://newagebd.com/detail.php?