“অরগেনাইজেশন অব ইসলামিক কোপারেশন” সংক্ষেপে ‘ওআইসি’ গঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। আগের নাম ছিল “অরগেনাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স”। সৃষ্টি লগ্নে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫৭টি মুসলমান অধ্যুষিত দেশ। যে দেশগুলোর জনসংখ্যা ২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১.৬ বিলিয়ন ছিল।
জন্ম নেয়ার পর সংগঠনটি ঘোষণা দিয়েছিল এই বলে যে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষার মধ্যদিয়ে তারা আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতি উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। এই ‘ওআইসি’র স্থায়ী প্রতিনিধি আছে জাতিসংঘে ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে। ৩টি ভাষাকে তারা তাদের সংগঠনের সাংবিধানিক ভাষা হিসেবে গ্রহন করেছিল। এ ভাষাগুলি হলো আরবী, ইংরেজী ও ফরাসী।
কিন্তু জন্মের পর থেকেই শুরু হয় সংগঠনের ভেতরে থাকা ধনবাদীদের চক্রান্ত। যে চক্রান্ত এখন ডাল-পালা গঁজিয়ে ধনিক শ্রণীর শুধু স্বার্থ রক্ষাই নয় সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে নিয়ম না মানা সন্ত্রাসের এক ভয়ঙ্কর রাজনীতি; যে রাজনীতির আঁড়ালে বর্তমানের আটপৌড়ে আঁতুড় ধনবাদ এখনও টিকে আছে।
২০১১ সালের ২৮জুন কাজাগিস্তানের এস্তনায় অনুষ্ঠিত ‘ওআইসি’র ৩৮তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে নতুন নামকরণ করা হয়েছিল আর সেই থেকে বর্তমান “অরগেনাইজেশন অব ইসলামিক কোপারেশন” নামেই অভিহিত হয়ে আসছে।
জন্মের পর থেকেই সংগঠনটিকে নানাবিধ কঠিন কঠিন সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়। এটা ঠিক, দুনিয়ার যেকোন কাজেই কিছু কিছু সমস্যার মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হয় এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একই নমুনার দুঃখজনক ঘটনাকে প্রতি নিয়তই প্রত্যক্ষ করার এমন ঘটনা মনে হয় একমাত্র “ওআইসি”রই দীর্ঘ ৪৮ বছরের পথপরিক্রমায় ঘটেছে। ফলে সংগঠনটি এখন আঁতুর ঘরে শেষ হয়ে যাওয়া একটি নির্জীব সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
তাই যদি না হবে তা’হলে আফগানদের যুদ্ধ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ, আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদী ইরাকযুদ্ধ, লিবিয়া যুদ্ধ এবং এখনকার চলমান সিরিয়া যুদ্ধ, সবকিছু মিলিয়ে কোন যুদ্ধ নিরসনেই এই ‘ওআইসি’ সামন্যতম কোন বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং অনেকটাই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছে। ফলে অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, ‘ওআইসি’কে মূলতঃ রাজতন্ত্রী আর সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ হাসিলের এক আখড়া হিসেবে গড়ে তুলা হয়েছিল। আর তাদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে এই সংগঠনটির নামের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার সারা মুসলমানকে খুবই চতুরতার সাথে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখনও করা হচ্ছে। এ না হলে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার চলমান রোহিঙ্গা সমস্যায় এই ‘ওআইসি’র কোন ভূমিকাই লক্ষ্য করা যায়নি। গত জুলাই মাসে ‘ওআইসি’র বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ডঃ ইউসুফ এ আল উতাইমিন ঢাকা এসেছিলেন। তিনি কক্সবাজার গিয়ে রোহিঙ্গা শ্মরণার্থী তাবু দেখার কথা ছিল। হয়তো তিনি সেখানে গিয়েছিলেন এবং দেখেছেনও। কিন্তু তথাস্ত! এর বেশী কোন তৎপরতা ওদের পক্ষ থেকে দেখা যায় নি।
জন্মের পরের বছরই সংগঠনের মূল নেতা সৌদির বাদশাহ্ ফয়সল বিন আব্দুল আজিজ আল সাউদ আততায়ীর হাতে নিহত হন। ১৯৭৫ সালে ২৫শে মার্চ তাকে তারই ভাতিজা ফয়সল বিন মুসেইদ হ্ত্যা করে। এর পর একের পর এক শুরু হয় হত্যা। আসে ১৯৭৫ সালের আগষ্ট। সংগঠন জন্মের ৬বছরের মাথায় সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব, সুবেহ সাদেকের এক লগ্নে তারই কাপুরুষ সেনাবাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। দুনিয়ার অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষকগন এই হত্যাকান্ডকে সাম্রাজ্যবাদী ষঢ়যন্ত্র বলেই অভিহিত করেছিল। বাংলাদেশ সেই ‘ওআইসি’র সদস্যরাষ্ট্র ছিল এবং এখনও আছে।
পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো যিনি চুয়াত্তরের সেই ‘কনফেরেন্স’এর সভাপতি ছিলেন তাকেও ১৯৭৯ সালে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। সেটিও ছিল জ্বলজ্যান্ত পরিষ্কার সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা সংগঠিত একটি হত্যাকান্ড।
এভাবেই গত হয় এক দশক। আসে ১৯৮১ সাল। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত নিহত হন আরেক প্রকাশ্য সাম্রাজ্যবাদী ষঢ়যন্ত্রের নীলনকশায়। দেশের সশস্ত্রবাহিনীর একটি প্রদর্শনীতে তাকে হত্যা করা হয়। তিনিও ‘ওআইসি’র শক্তিশালী কারিগর ছিলেন।
বহু আন্দোলন সংগ্রাম আর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘ওআইসি’র চোখের সামনে দুনিয়া অতিক্রম করে দুই দশক। আসে ২০০৪ সাল। বিশ্ব নন্দিত ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ইয়াসির আরাফাতের অপরাধ ছিল তিনি ফিলিস্তিনীদের ন্যায্য দাবী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন। আর সাম্রাজ্যবাদীদের নাটের গুরু আমেরিকা ছিল সেই মূহুর্তে ইসরাইলের পক্ষে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে।
ষঢ়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত চলতেই থাকে।
দুনিয়ার লুটেরা ধনীকগুষ্ঠী, সাম্রাজ্যবাদী চক্রিরা তাদের চক্রান্তের গুপ্ত-প্রকাশ্য মহড়া চালিয়ে যেতেই থাকে যেমন এখনও চলছে। এরা চতুর তবে ঘৃণ্য স্বার্থান্ধ রাজনীতির পরিতোষনকারী। নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে এরা পারে না এমন কোন কাজ নেই দুনিয়ায়। ঘৃণ্য ষঢ়যন্ত্রের নারকীয় পথে এরা টিকে থাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে। এদের ষঢ়যন্ত্রের সেই মাকড়শার জাল ছিন্ন করতে যে বা যারাই এগিয়ে এসেছে তাদের গায়েই ‘একনায়ক’, ‘স্বৈরাচার’ বা অন্যবিদ তকমা লাগিয়ে তাদেরকে হত্যা করিয়েছে। আজকের দিনের আইএস নেতা আল বাগদাদি থেকে শুরু করে সাদ্দামসহ দুনিয়ার তাবৎ একনায়ক এদের মদদেই সৃষ্টি হয়েছে আবার নিজেদের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিলেই এদের হত্যা করানো হয়েছে।
ষঢ়যন্ত্রের যুদ্ধ ইরাক-আমেরিকা-আফগানিস্তান যুদ্ধ চলার সময়ই ঘটে আরেক হত্যাযজ্ঞ। ২০১১ সালের অক্টোবর মাস। লিবিয়ার সিরতে যুদ্ধ চলাকালীন সময় মোয়ামের গাদ্দাফী মারাত্মক জখম অবস্থায় ধৃত হন এবং সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তাকে ধৃত হওয়ার একঘন্টার মধ্যে হত্যা করা হয়।
‘ওআইসি’ এখনও আছে তবে নখরবিহীন কাগুজে বাঘ হয়ে। কারণ তারা আসলেই যে দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কথা বলে না। এটাই সত্য।