আব্দুল ওয়াদুদ।। আবহমান বাংলার কুটিরশিল্পের এক অনন্য ঐতিহ্য রঙিন বেতের বুননে তৈরি শীতলপাটি। গ্রামবাংলার কারও ঘরে অতিথি এলে মাদুর বিছিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রেওয়াজ বাংলার হাজার বছরের। বঙ্গের উত্তর-পূব অঞ্চলের ঐতিহ্য শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়ে অতিথির আপ্যায়ন। এ রেওয়াজ শত শত বছরের পুরনো। তবে সম্প্রতি এ ঐতিহ্যে ছেদ পড়েছে। বাজারজাতকরণ, মূলধনের অভাব, ন্যায্যমূল্য ও মুর্তা বেতের অভাবে বিলুপ্তির পথে মৌলভীবাজারের ঐতিহ্যবাহী এ বেতশিল্প।
সম্প্রতি জেলার রাজনগর উপজেলার বিলবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের উঠানে পাটির সুনিপুণ নির্মাণ চলছে বিরামহীনভাবে। নানা আকৃতির পাটি সূক্ষ্ম বুননে পাচ্ছে নান্দনিক শিল্পরূপ। পারিবারিক কাজের ব্যস্ততা ও অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও মনের টানে এখনো অনেক পাটিশিল্পী বাঁচিয়ে রেখেছেন পূর্বপুরুষের শিখিয়ে যাওয়া এ শিল্প। জেলার রাজনগর উপজেলার বিলাবাড়ি, যুগিকোনা ও ধুলিজোড়া গ্রামে কয়েক যুগ ধরে সুনিপুন পাটি তৈরি ও বাজারজাত করেছেন আদি প্রস্তুতকারীরা । তবে এখন নেই আগের সেই জৌলুস।
গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ‘মুর্তা’ থেকে এই শীতল পাটি তৈরি করা হয়।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ইউনেসকোর ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ (আইসিএইচ) কমিটির ১২তম অধিবেশনে বিশ্বের নিবর্স্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ২০১৭ (দি ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমানিটি) হিসেবে বাংলাদেশের এ শীতল পাটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
রাজনগর উপজেলার বিলবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সত্তর উর্ধ্ব বয়সী ধীরেন্দ্র কুমার দাশ শীতল পাটি তৈরি করতে নিজের বাড়ির উঠানে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। তার সাথে একান্ত আলাপচারিতা হয় এ পাটি শিল্প নিয়ে।
তিনি বলেন-“প্রায় ১শ বছর ধরি আমরার বাপ-দাদারা এ পেশা ধরিয়া রাখছইন”। তার দাদা প্রয়াত রামচরণ দাশ ও পিতা প্রয়াত দীনেশ কুমার দাশ এ পেশায় জড়িত ছিলেন।তাদের বুনন দেখে তিনি এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন সেই ছোটবেলা থেকে। তিনি এই পাটি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বুনন করে নিজে বিক্রি করেছেন। তিনি সর্বন্মি ৭-৮ হাজার টাকা দামের পাটি তৈরি করেন। সূক্ষ-নিপুন বুনন পাটি ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে বেশি মূল্যে এই পাটি তৈরি করতে মাস-দেড় এক সময় লাগে। তার কাছ থেকে জানা যায়, ওই গ্রামের শ্রীকান্ত দাশ, রমা কান্ত দাশ, নিরদ দাশ, সুধির দাশ, অগদুর দাশ, পুরঞ্জয় দাশ, রঞ্জয় দাশ, রাইমন দাশ, অষ্টিনি দাশ, তুলাপুর গ্রামের গিতেশ দাশ পাটি তৈরি করতেন। এরা কেউ এখন আর বেচেঁ নেই। তবে তার ভাই সত্যেন্দ্র দাশ কৃষি ক্ষেতের ফাঁকেফাঁকে পাটি তৈরি করে।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে একাধারে ৪০ বছর ধরে রাজনগরের কুশিয়ারা নদী পাড়ের বিলবাড়ি কানাই আশ্রমের সামনে বিক্রি করা হয় প্রসিদ্ধ এই পাটি। কয়েক যুগ ধরে রাজনগরের বিলবাড়ি, উজান বিলবাড়ি, যুগিকোনা, ধুলিজোড়া গ্রাম থেকে পাটি প্রস্তুতকারীরা পাটি নিয়ে জড়ো হতো এই কানাই আশ্রমে। তার ভাষায়, সেই সময়ে সিলেটের রেঙ্গা পরগনা, মৌলভীবাজার, জুড়ী, বড়লেখা ও কুলাউড়া থেকে শত শত পাইকাররা এসে ভীড় জমাতেন এখানে।
আক্ষেপ করে তিন মেয়ে সন্তানের জনক এই ধীরেন্দ্র দাশ বলেন- “এখন আগের লাখান পাটি তেমন একটা বানাইতাম (বুনন করতে) পারি না। মুর্তা বেতের অভাব, টেকা-পয়সার অভাব ও বাজারের অবস্থা ভালা না থাকায়, উচিৎ দর (ন্যায্যমূল্য) পাইনা”।
সুনিপুন বুননের পাটি বিক্রি করে কষ্টের সংসারে তিনি দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তার বলেন, বালাগঞ্জে শীতল পাটি তৈরি হয়না। কুশিয়ারা নদীর ওপাড়ে রাজনগরের বিলবাড়ি ও নদীর ওপাড়ে সিলেটের বালাগঞ্জবাজার গড়ে উঠায় এককালে বালাগঞ্জের মদন মোহন আখড়ায় পাটি বিক্রি করতো রাজনগরের পাটি প্রস্তুতকারীরা। তার কথায়- “আসলে বালাগঞ্জে কোন শীতলপাটি বানানি (প্রস্তুত) হয়না। তবে, “বালাগঞ্জের তেগরি ও খলাগাঁও এলাকার কিছু মানুষ ২৫০-৩শ টেকা দামের পাটি লইয়া আইতো। এই পাটি দেশী-বিদেশী মাইনষর (মানুষের) ব্যবহারের লাগি মানাইতো (উপযোগী) নায়”।
উপজেলার পাঁচগাও ইউনিয়নের ধুলিজুড়া ও উত্তরভাগ ইউনিয়নের যুগিকোনা গ্রামেও এ হস্তশিল্পের কদর কয়েক যুগ ধরে। এখনো এসব গ্রামে ওই পাটি বুননে তৎপড় রয়েছেন অনেক পরিবার। এরাও একসময় বিলবাড়ি কানাই আশ্রমে পাটি বিক্রি করতো। কালের আবর্তে সেই নিখুত বুনন শিল্পীরা নিজেদের কিছুটা গোটিয়ে নিলেও একেবারে বসে নেই তারা। অনেকেই রাজনগর, টেংরাবাজার ও মৌলভীবাজার গিয়ে এসব পাটি বিক্রি করেন। ধুলিজুড়া গ্রামে “শীতল পাটি শিল্প পরিষদ” নামে গড়ে উঠেছে একটি সংগঠন। সভাপতির দ্বায়িত্বে আছেন বেনু ভূষন দাশ, সাধারণ সম্পাদক পূর্নেন্দু দাশ পবিত্র।
পরিষদের সম্পাদক ওই পূর্নেন্দু দাশ পবিত্র বলেন, এই গ্রামের পূর্ব পুরুষেরা প্রায় কয়েক যুগ ধরে বিলবাড়ি কানাইর আখড়ায় পাটি বেচতে যেতেন। কালের আবর্তে এই ব্যবসায় ভাটা পড়ায় অনেকটা গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে এখনো কোন ভাবে চলছে এই বুননশিল্পের কাজ। ৫০/৬০ বছর পূর্ব থেকে ওই গ্রামের প্রয়াত উমাচরণ দাশ, নূর উত্তম দাশ, ললিত মোহন, গৌরাঙ্গ কুমার, প্রমোদ রঞ্জন, জগত বিহারি, প্রেমানন্দ, রামানন্দ, রাস বিহারি, শোন দয়াল, খোকা রাম, করুনাময়, প্রহল্লাদ, প্রসন্ন কুমার এ পেশায় জড়িত ছিলেন। এরা কেউ আর বেচেঁ নেই। এখন বংশ পরম্পরায় ওই গ্রামের হরেন্দ্র কুমার দাশ, প্রমেশ রঞ্জন, দিবেশ চন্দ্র, বেনু ভূষন, অরুন দাশ, রিপন দাশ, আরতি রানী দাশ, রেপতি রানী, দিপ্তি রানী, ভানু ভূষন, কালাচাঁদ, শুশিল চন্দ্র, অজিত কুমার, বিজয় কৃষ্ণ, সুশীতল দাশ ও মতিলাল দাশসহ অনেকেই এই বুনন শিল্পে জড়িত। তার কথায়, গ্রামে কয়েক যুগ ধরে শতাধিক পরিবার পাটি বুনতো। এখন যদিও পেটের তাড়নায় ক্ষেত-কৃষি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের তবুও ওই গ্রামে ৩০/৩৫ পরিবার বাপ-দাদার আদি পেশা ধরে রেখেছেন। এছাড়াও উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের যুগিকোনা গ্রামের মৃত বলাই দাশ, অমৃকা দাশ, উপেন্দ্র দাশ, সাদু দাশ, খেতকি দাশ, বিরেন্দ্র দাশ, রবীন্দ্র দাশ, রতি মোহন দাশ দীর্ঘদিন যাবৎ পাটি বুনেছেন। বংশ পরম্পরায় বর্তমানে অমেরন্দ্র দাশ, শৈলেন্দ্র দাশ, কৃপেষ দাশ, জগমোহন দাশ, প্রতাপ দাশ, মাখন দাশ, অতিরঞ্জন দাশ ও রাখাল দাশ কোন মতে ঠিকে আছেন বাপ-দাদার এই পেশাকে ধরে। এছাড়াও জেলার বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার ও তালিমপুর ইউনিয়নে এখনো সুনিপুনভাবে শীতলপাটি তৈরি হয় ।
যেভাবে তৈরি হয় পাটি : মুর্তা নামক এক প্রকার গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ’র ছাল দিয়ে এই পাটি তৈরি করা হয়। এ গাছ ওই এলাকার গ্রামাঞ্চলের বাড়ির পিছের ডোবার পাড় ও ঝোঁপ-জঙ্গলে পাওয়া যায়। গাছ কেটে ধারালো দা বা বটি দিয়ে গাছটিকে লম্বাভাবে ৪/৫ টুকরো করে গাছের ছাল বা বেত বের করা হয়। অতঃপর এক ঘণ্টা বেতগুলো টিনের পাত্রে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে সেদ্ধ করার পর তুলে এনে রোদে শুকিয়ে পুনরায় ঠান্ডা ও পরিষ্কার পানিতে ৩/৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে তোলা হয়। এরপরই মুর্তা বেত পাটি তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হয়।
বিভিন্ন রংয়ের বাহারী নামের পাটির মধ্যে রয়েছে সাদা পাটি, গুছি রঙ্গা পাটি, আসমান তারা, চৌদ্দ ফুল কমল গুশ পাটিসহ হরেক রকম ।
জেলার পাটির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ তোফায়েল ইসলাম’র সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপচারিতা হয়। তিনি বলেন, শীতল পাটি শিল্পের বিকাশের জন্য যদি কেউ আমাদের কাছে এগিয়ে আসেন তাহলে জেলা প্রশাসন ও সরকারের তরফ থেকে তাদের সহায়তা দেয়া হবে।