হারুনূর রশীদ॥ শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড। এমনই বলা হয়ে আসছে সুদূর অতীতের কোন এক কাল থেকে। আজো চলছে। আর কথাতো সত্য। একটি জাতির ভবিষ্যৎ সন্তানকে প্রাথমিকভাবে একজন শিক্ষকই তৈরী করে দেন। এটি সভ্য মানুষের আদি পেশার একটি। দুনিয়ার মানব সমাজ এভাবেই গড়ে উঠেছে। এটি শুধু আমাদের দেশ নয়। বললে নিশ্চয়ই ভুল হবে না যে এমন অবস্থা বিশ্বের সর্বত্রই কাজ করছে। দুনিয়ার সকল দেশেই প্রত্যেকের নিজস্ব একটা শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে তাদের নিজ নিজ ভাষার উপর ভর করে। মানব সভ্যতার নিরন্তন যাত্রায় দুনিয়ার মানুষ আজকের এমন অবস্থায়ই এসে দাঁড়িয়েছে। সকল দেশের সকল সমাজের, সকল সম্প্রদায়ের শিক্ষার নিজস্ব নিকেতন রয়েছে। সেখানে কাজ করেন এই শিক্ষক নামের সুশীল সৃজনশীল মানুষগুলো। পই পই করে নিজেদের জ্ঞানের সবটুকু ঢেলে দিয়ে গড়ে তোলেন ভবিষ্যৎ দেশ গড়ার কারিগরদের।
এখনকার মত আগে এমন ছিল না। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে যা গড়ে উঠেছিল তা ছিল গুরুগৃহ। শিক্ষায় আগ্রহীরা গুরু গৃহে গিয়ে শিক্ষকের সাথে বসবাস করে শিক্ষা নিতেন। গুরুকে দক্ষিণা দিতেন নিজেদের ইচ্ছায় ও অবস্থার মাপকাঠিতে। গুরু গৃহে থেকে গুরুর সাংসারিক কাজকর্মে সাহায্য সহায়তাই ছিল গুরু দক্ষিণা। গুরুও কোনকালে দক্ষিণা নিয়ে দামদর করতেন না। অন্তরের গভীর থেকেই দক্ষিণা যা কিছুই হতো তাই নিয়ে অপার সন্তুষ্ট থাকতেন। আজকের সময়ে এসে এ চিন্তায় ও পদ্বতিতে বিবর্তন ঘটেছে। এখন শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের জন্য আর গুরুগৃহে যেতে হয় না। এখন গুরুই নিজে এসে বসেন অন্য গৃহে শিক্ষা দানের জন্য। যাকে বলা হয় বিদ্যানিকেতন। ইংরেজী ভাষায় বলে ‘স্কুল’ আর আরবী বা ফার্সিতে বলে মক্তব ও মাদারসা। চিন্তা ওই একই কাজও ওই আগেরই। দেশ বা সমাজের ভবিষ্যৎ কারিগর গড়ে তোলা। আগের গুরুগৃহ আর এখনকার বিদ্যালয় মূলগতভাবে একই বিষয়।
মানুষ বিশ্বাস করে- ভগবান, আল্লাহ, ইশ্বর বা খোদা এককথায় স্রষ্টা মানুষকে শিক্ষার দায়ীত্ব নিজে না নিয়ে তার প্রতিনিধি স্বরূপ মানুষকে দিয়েই শিখিয়ে দেয়ার নিয়মে চলেন। আর এ নিয়মে চলেন বলেই সেই আদিকাল থেকে শিক্ষার জন্য মানুষের এমন আয়োজন। সে চিন্তাজগতের ভিন্ন প্রসঙ্গ।
কিন্তু কালের যাত্রার স্রোতে প্রাচীন সে চিন্তায় এসেছে পরিবর্তন। বিশ্বে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে হু হু করে। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে মানুষের চাহিদাজগৎ বিস্তৃত হয়েছে। গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা গ্রহনের পদ্বতি এখন আর ভারতীয় উপমহাদেশে কোথায়ও আছে বলে শুনিনি। তবে হ্যাঁ আদিবাসী সমাজে ছিঁটেফোঁটা থাকতেও পারে। অর্থ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি বা দূর্বলতার কারণে এমন থেকে যাওয়া আশ্চর্য হবার কিছু নয়। থাকলেও এগুলো এখনকার সমাজে ব্যতিক্রম। পরিবর্তন শুধু এখানেই নয়। পরিবর্তন হয়েছে গুরু বা শিক্ষকের মস্তিস্ক জগতেও। গুরু এখন আর নিজগৃহে শিক্ষা দেন না। শিক্ষাচ্ছুদের জন্য গড়ে তুলা হয়েছে বিশাল বিশাল নিকেতন। কাজ কিন্তু ওই হাজার বছর আগেরই। শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। সেই শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় নতুনকরে যোগ হয়েছে যার যার নিজের মত করে গড়ে তোলা। রোমানদের মনে কাজ করতো, গোটা বিশ্বের মানুষ লেটিন ভাষায় কথা বলুক।লেটিন সংস্কৃতি নিয়ে মগ্ন থাকুক। আরবীয়ানদের মনে কাজ করে, সারা দুনিয়ার মানুষ আরবী ভাষায় কথা বলুক। কালের কোন এক পর্বে সুযোগ যখন তাদের হয়েছিল তখন রোমানদের মতো তারাও সে সুযোগকে নিঃসংকোচে ও নির্বিবাদে কাজে লাগিয়েছিল। ইতিহাস ঘাটালে এর পরেই দেখা যায় ইংরেজ, ফরাসী, ওলান্দাজ কিংবা পর্তুগীজরা আরবীয়ানদের মতো তাদের ভাষাকেও যতদূর হাত যায় পৌঁছাতে তারা পিছপা হয়নি। বরং যুদ্ধংদেহী হয়ে এগিয়ে গেছে। এই নিজের মত করে গড়ে তোলার মানুষের অভিপ্রায় মূলগত সত্যানুসন্ধানী শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে ব্যবসায়ীক শিক্ষার চিন্তা মানব মনে স্থান করে নেয়। এ অনুশীলনে মানব সভ্যতার দশ হাজার বছর পরে আমরা আজ যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে তার মূল প্রেরণা সত্যানুসন্ধান নয় বরং নিজের মত করে বিলাসী জীবনের আয়-রোজগারের জন্য কিছু শিখে নেয়া। এ শিক্ষায় মানুষ মানুষকে ঠকায় কৌশলে। যাকে ভদ্র পরিচয়ে আমরা বলি কূটকৌশল। ইংরেজগন বলেন-‘ডিপ্লোমেসি’!
পরিবর্তন-বিবর্তনের স্রোতধারায় আমাদের শিক্ষক সমাজের পরিবর্তনে একদিকে যেমন উন্নত মনষ্কতার ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয় বিপরীতে ঠিক তেমনি আদিম বর্বরতাও যেনো ফিরে এসেছে মানুষের মাঝে বলেই মনে হয়। কিছু কিছু শিক্ষকদের মাঝে তেমনই কিছু স্বভাব দেখতে পাওয়া যায়। পরিবর্তনে সবকিছুই খুব ভাল হবে এমন কোন সময়ই হবার নয়। কেবল প্রাকৃতিক পরিবর্তন কোন নিয়ম ভাঙ্গে না। একই নিয়মে খুবই ধীর গতিতে বিবর্তিত হয়ে হয়ে চলে। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সে পরিবর্তন আসে। প্রাকৃতিক নিয়মের পাশাপাশি সামাজিক পরিবেশের প্রভাব মিলিত হয়ে যে পরিবর্তন আসে সেখানে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। তবে সে ব্যতিক্রম সীমা ছাড়ায়ে গেলেই ঘটে বিভ্রাট।
স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের পথ চলায় যে নতুন শিক্ষক সমাজ আমাদের গড়ে উঠেছে সেখানে গুরু দ্রোণাচার্যের সংখ্যা বিপুল আছে নেই শুধু শিষ্য একলব্যের মত শিক্ষার্থী। দ্রোণাচার্যের এর পাশাপাশি নব্য দূর্যোধনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর কারণ অবশ্যই রয়েছে। বিশ্ব মানব সমাজের জীব হিসেবে প্রকৃতির বিবর্তনের ধারায় আমাদের জীবনেও পরিবর্তন বিবর্তন সাধিত হয়ে চলেছে। এর থেকে ইচ্ছে করলেও আমরা সরে থাকতে পারবো না।
লক্ষ্য করার বিষয়, আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আজো আমরা আমাদের শিক্ষার অনেক কিছুই, আমাদের বহু সমৃদ্ধ নিজস্ব ভাষায় করতে সক্ষম হইনি। নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজন যে গবেষণার তাতে আমাদের দৃশ্যমান কোন পদচারণা নেই। এখনও আমরা ডাক্তারী, কারিগরী এমন কি আইন পড়তে গেলে ভিন্ন ভাষায় পড়তে হয়। আমাদের ভাষায় সে বিষয়গুলোকে তুলে ধরতে পারিনি। কিন্তু কেনো পারিনি এ জবাব কে দেবে? আমাদের সুশীলরা শুধু কথায়ই সুশীল। কাজে অশ্বরম্ভা!
আরবী ভাষায় ‘ওয়াজ’ করতে কিংবা ইংরেজী ভাষায় ‘লেকচার’ দিতে আমরা খুবই অভিজাৎ কাজ বলে মনে করি। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধীজীবি থেকে সাধারণ এই আমরা পর্যন্ত সকলেই আমরা এ বিপন্ন নেশাঘোরে আছি। তার পেছনেতো কারণ অবশ্যই আছে। আমাদের কারণ সুদীর্ঘকাল বিদেশী শাসকদের দ্বারা শাসিত হওয়া একটি। ফেলে আসা অতীতের বিভিন্ন সময়ে আমরা শাসিত হয়েছি আরবী-ফার্সী ভাষাসংস্কৃতির মানুষদের দ্বারা। তারও আগে আমরা শাসিত হয়েছি আর্য্যদের দ্বারা। তার পর আফগান, মোগল, ইংরেজ পার হয়ে সর্বশেষ পাকিদের দ্বারা।
আরেকটি কারণ আমাদের ধর্মীয় পরিচিতি। আমাদের শিশুরা গড়ে উঠে চারটি পদ্বতি অনুশীলনের ভেতর দিয়ে। আমাদের কিছু সংখ্যক শিশুরা গড়ে উঠে বড় বড় শহরে থেকে।যেখানে চর্চিত হয় আধুনিকতার নামে বিদেশী ইংরেজী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির। আরেক পক্ষ শিশু গড়ে উঠে মাঝারি শহর বা বলা যায় আধা গ্রাম আধা শহর জাতীয় এক ধরনের পরিবেশে যেখানে মিশ্র ভাষা সংস্কৃতির আবহে থেকে ইংরেজী শিক্ষার সাথে আরবী শিক্ষা ও সংস্কৃতির শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠে। নিজের মাতৃভাষার শিক্ষা এ পরিবেশে কিছুটা পেয়ে থাকে। আরেক পক্ষ শিশু গড়ে উঠে পুরো গ্রামীণ পরিবেশে থেকে। সেখানে কি হয়? আমাদের বেশীর ভাগ গ্রাম গঞ্জে এখনও চর্চিত হয় ধর্মের নামে বিদেশী আরবী-ফারসী ভাষা ও সংস্কৃতি। ইদানিং ইংরেজীও সেখানে টিপ টিপ করে জায়গা করে নিচ্ছে।এতো সবের চাপের ঠেলায় নিজের ভাষায় শিখে যাবার সময় কোথায়। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নিজের ভাষা সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে নিজেকে জানার-বুঝার কোন ফুরসৎই পাওয়ার সুযোগ নেই। সমাজকে আমরা এমনভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি যেখানে মৌলিক সত্য শেখা বা জানার স্থানই নাই। অর্থ না জানিয়েই আমাদের কোমলমতি শিশুদের শিখানো হয় শিখে নাও মুখস্ত করে নাও, সোয়াব আছে। অর্থ কি এই নয় যে, আপাততঃ হলেও মূল জ্ঞান জানার প্রয়োজন নেই। মুখস্ত করে নাও। মরিলে বেহেস্ত পাবে। পক্ষান্তরে অন্য শিক্ষা কি? স্কুলের শিক্ষা। সেখানে নিজের ভাষার আগে এ বি সি ডি অক্ষরের বিদেশী ভাষাটি আগে শিখতে হবে। কারণ বিদেশ যেতে হলে ওটি প্রয়োজন। কিন্তু কেনো আমাকে বিদেশ যেতেই হবে সে বিষয়টি জানার জায়গাই রাখা হয়নি। সবচেয়ে হাস্যকর হলো একপক্ষ, একেবারে ঢেকে রাখতে চায় মেয়েদের। অন্যপক্ষ অর্ধ নেংটা করে রাখতে ভালবাসে। আমার নিজেরটা পরিধানের প্রয়োজনীয়তা যেনো ফুরিয়ে গেছে। অথচ আমরা যে জানিনা তা নয়, বরং আমরা ভালভাবেই জানি যে এ বিশ্বে বহু গরীব আদিম সংস্কৃতির জাতি আছে যারা বিশ্ব সভায় তাদের নিজেদের পোষাকে আসবেই। নিজের ভাষায় কথা বলার সাহস রাখে। গরীব হলেও নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে নিয়ে গবেষণা করে গর্বও করে। আমাদেরকে নিয়েও গর্ব করার সে স্থান থেকে আমরা কিভাবে যে বিচ্যুত হয়ে গেলাম, সে এক বিষ্ময়কর ধাঁধাঁর মতো বিষয়।
এতোসব জানা শুনার পরেও আমরা মানুষকে বিদেশ যাওয়ার প্রতি উসকে দেই। দেশ ছেড়ে চিরতরে বিদেশ যাওয়াকে আমরা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করেই চলেছি একেবারে খোদ মন্ত্রণালয় খুলে। সেই মন্ত্রণালয়েও চলে চরম দূর্ণীতি। মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো নারীদের দূরবস্তা নতুন করে এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কাজে, শিক্ষা অর্জনের তো প্রশ্নই আসে না, মৌল উদ্দেশ্য দেশের নামে নিজেদের আয় বাড়ানো।
লণ্ডন, মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী ২০২১ |