হারুনূর রশীদ।।
মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতাযুদ্ধ দু’টো ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আমরা দু’টুকে গুলিয়ে ফেলে এক করে দেখি। অন্ততঃ আমরা দেখে আসছি সেই সত্তুর(১৯৭০) সাল থেকেই। পাকিস্তান আমলের সে সময়ে প্রগতিশীল দলগুলো এসব গভীর কূট রাজনৈতিক আলাপ নিয়ে সরগরম ছিল। তাদেরই উত্তরসূরীগন এ বিতর্ক আজ অবদি জিইয়ে রেখেছেন। তাদের এ বিতর্ক যে বেহুদা ছিল তা অবশ্যই নয়। এসব বিতর্কের মূলে জানার অনেক কিছুই ছিল এবং এখনও আছে। স্বাধীনতার পর তাদের এ বিতর্কের সফল সঙ্গী হয়েছিল স্বাধীনতার প্রকাশ্য বিরুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি জামাত ও মুসলীম লীগের কিয়দংশ। তারা তাদের সুবিধার জন্য সে আলাপের সুযোগ নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর তাদের এ বিতর্ক আরো ডাল-পালা দিয়ে বেশ একটি বিশাল গাছে পরিনত হয়ে উঠেছে। এখন এর নতুন নতুন কিছু ব্যাখ্যাও মাঝে মধ্যে শুনা যায়। অবশ্য নতুন ব্যাখ্যা আসা অমূলক কিছু নয়। বিশ্বের সবকিছুতে একটা পরবর্তন প্রতিনিয়ত হয়েই যাচ্ছে এবং এ পরিবর্তন শ্বাশত। অতএব নতুন নতুন ব্যাখ্যা আসতেই পারে।
পাকসামরিক শাসন আমল
পাকসামরিক শাসন আমলের সূর্য তখন মধ্যগগণে। তেজে ঝকঝক চক চক করছে। যেহেতু মুসলমানের কল্পিত দেশ ‘পাকিস্তান’, অতএব সবকিছুতে মুসলমানদের অগ্রাধিকার থাকতেই হবে। এই সুযোগে চলছে অবাধ লুন্ঠন। আঘাটে ঘাট আর আপথে পথ সৃষ্টি চলছে অবাধে।
হঠাৎ শিকার পাওয়া মানুষখেকো বাঘের মত চলছে পশ্চিমের পাকিস্তানীদের লুন্ঠন। জনসংখ্যায় আমরা বাঙ্গালীগন পশ্চিমপাকিস্তানীদের চেয়ে বেশী ছিলাম। সুতরাং সম্পদ বা উন্নয়ন সব ভাগাভাগিতে আমরা কিছু বেশী পাওয়ার কথা। বিষয়টিকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ধুরন্ধরী কৌটিল্য কৌশলে মুসলমান ভাই-ভাইয়ের সমতার বাখান শুনিয়ে লুটপাট শুরু করেছিল। অগাধ বিশ্বাসে সে সময়ের বাঙ্গালী নেতৃত্ব, সোহরাওয়ার্দি-শেরে বাংলা পাকিস্তানী আরব্যহিকমতীয় নব্যচানক্যনীতির সেই অসমতাকে সমতার বিভাজনে থাকা উত্তম বলে মেনে নিয়েছিল। পাকিস্তানীদের সে লুটপাটে অংশ নিয়ে নিরীহ গরীব হিন্দুদের ভুমি দখলসহ এমন কোন অসৎকাজ বাকী ছিলনা যা পশ্চিম পাকিস্তানীরা ও তাদের পূর্বপাকিস্তানী তাবেদারগুষ্ঠী করেনি। পাকিস্তান, মুসলমান আর মুসলিমলীগের নামে সবলুটেরাদের দল যে যেভাবে সুযোগ পেয়েছে লুটপাট করেছে।
সেসময় সারা ভারতে বহুলাংশে বাঙ্গালীরাই বিভিন্নমুখী দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সারা ভারতময় বহুলাংশে বাঙ্গালীদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, স্বাধীন পাকিস্তানের উদ্ভবে বৃহৎবাঙ্গালীদের সে আন্দোলন স্বাভাবিককারণেই একটু থমকে গিয়েছিল। পূর্বপাকিস্তানে নতুন সমীকরণে পৌঁছতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে কিছুটা সময় নিয়ে শুরু করতে হয়েছিল। রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যাওয়ায় প্রগতিশীল শক্তি বুঝতে পারে বৈঠকঘরের এ স্বাধীনতা নিছক লোকঠকানো ছাড়া অন্য কিছু নয়। শুধু শাসন নয়, শাসন- শোষণের নতুন রূপ মাত্র। অতএব কেবলই স্বাধীনতা নয়, স্বাধীনতার পাশাপাশি আমাদের সকল শোষণ ও শৃঙ্ক্ষলের হাত থেকে লড়াই করে মুক্তি আনতে হবে। সে চিন্তার অবস্থান থেকে তাদের ব্যাখ্যা ছিল এইযে, বাঙ্গালীদের এ লড়াই শুধু শুধু একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ নয় এটি সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তির লড়াই। অতএব বাঙ্গালীরা শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলন লড়াই করে আসছে সেই ইংরেজদের আমল থেকেই। এ স্বাধীনতা যুদ্ধ তারই ধারাবাহিকতা।
দ্বিজাতি তত্ত্ব
ধুরন্ধর ইংরেজদের ব্যবস্থাপত্র ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ ছিল দুনিয়ার দিকে দিকে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তারী শোষণ-রাজনীতি বিরুধী মুক্তির আন্দোলনকে নিশ্চুপ করে দেয়ার ভারতীয় সংস্করন। এ ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ ছিল তাদের শোষণ থেকে বিশাল ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মুক্তির লক্ষ্যে চালিত আন্দোলনকে বিনষ্ট করে কূটকৌশলে নিজেদের বিজয়কে নিশ্চিত করা। বিশাল ভারতকে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত রেখে নিজেদের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থরক্ষার একটি নীল নক্সাও ছিল এই ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’ এবং এর মূলকথা। যে ভারতীয় জাতিগুষ্ঠী সুদীর্ঘ সহস্রাব্দেরও বেশী কাল অবদি নির্বিবাদে এক হয়ে থেকে দুনিয়ার বুকে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল সেসব জাতিগুষ্ঠীকে পদানত করে রাখার অশুভ ইচ্ছায় ইংরেজরা তাদের এদেশীয় দুসরদের সহযোগীতায় এই ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’এর উদ্ভাবন করেছিল। পাকিস্তান-হিন্দুস্তান সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রস্তাবনা ছিল। স্বাধীনতার নামে তাদের ভারতীয় পদলেহীরা এই প্রস্তাবনাকে মেনে নিয়ে দেশকে দু’ভাগ করে নেয়ায় পাকিস্তানের জন্ম। এতে সাধারণ মানুষের মুক্তির আন্দোলন থেমে থাকতে পারেনা। বাঙ্গালীদের এ আন্দোলন তাই শুধু শুধু একটু ভূখণ্ডকে ভাগ করে নেয়ার আন্দোলন নয়। এটি সকল ধরনের শোষণ থেকে বাঙ্গালীদের চির মুক্তির আন্দোলন। তাই লড়াইয়ের এ পর্যায়ে এসে এটি শুধু আর স্বাধীনতা যুদ্ধ থাকেনি হয়ে উঠেছে মহান মুক্তির যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধ।
সেসব দিনের ছাত্রআন্দোলনে(যে ছাত্র আন্দোলন এ দেশের স্বাধীনতা এনেছে) জড়িত দেশের সাধারণ মানুষ অতোসব তাত্ত্বিক কথার সাথে পরিচিত ছিল খুব অল্প সংখ্যায়। তাই এসব বিতর্কে কেউ এগিয়ে আসতো না স্বতঃস্ফূর্তভাবে। প্রতিবাদও কেউ করতে চাইতো না কারণ এসব তথ্য আর তত্ত্বকথা তাদের জানা ছিলনা। এখন অনেকেই এসব গভীর রাজনীতির কথা বুঝেন। এ অবস্থানে আসতে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে অনেককিছু ত্যাগ করতে হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের পর স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যদিয়ে মানুষের কাঁধে চেপে বসা মধ্যযুগীয় শোষণমূলক ধর্মীয় অনুশাসনসহ আরো অনেক রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান হয়েছিল। চিরতরে সেসব লুপ্ত হয়ে যাবার কথা ছিল। ধর্মভিত্তিক পূর্বপাকিস্তান থেকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ হলাম। কিন্তু নব্য মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদের বগলে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা সেই অশুভ শক্তি আবারো মাথাচাড়া দিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে উঠে আসে। আবারো মানুষের ঘাড়ে সোয়ার হয়ে উঠে। প্রগতিশীলরা জোটবদ্ধ হতে শুরু করেন। নরহত্যার অপরাধে শাস্তি পাওয়া অপরাধীরা সুযোগের সদব্যবহার করে নবউৎসাহে জোটবদ্ধ হয়। আসে ২০১৮এর নির্বাচন। সে নির্বাচনে দেশের পিয়ন থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর প্রধান পর্যন্ত কোথায়ও কারো কাছে তারা স্থান পায়নি। ভোটে তাদের পরাজয়ের নমুনা বলে দেয় যে দেশের সাধারণ জন-মানস চিরতরে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাখ্যানের অর্থ এই নয় যে এ অশুভ শক্তিকে সমূলে তুলে ফেলে ময়লাবাক্সে ফেলে দেয়া হয়েছে। বরং এরা এখনও আছে। শুধু কি আছে, এখন তারা আর ঘাপটি মেরে নেই। প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে আবারো উঠে দাঁড়াবার অবিরত চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে।
ধর্মের ভিত্তিতে তৈরী পূর্বপাকিস্তানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে সাতচল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বলতে গেলে সুদীর্ঘ এ সময়ে এই অপরাধী শক্তি কখনই পিছু ছাড়েনি। আজ একজনের বগলে তো কাল অন্যজনের বগলে। এভাবেই তারা রাজনীতির কূটকৌশলে এবং আমাদের নিরীহ ধর্মপ্রিয় মানুষের কোমল মনে ধর্মের স্পন্দন জাগিয়ে সবকিছু ওলট-পালট করে দিতে সদাপ্রস্তুত। এরা সবসময়ের এক প্রতিবন্ধকতা, এক অভিশাপ! ধর্ম, গণতন্ত্র এসবের দোহাইয়ের আলখেল্লায় বিদেশী ভাড়াটে হিসেবে প্রগতিশীলদের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখতেই এরা বিশ্বময় সচ্চেষ্ট! এ অবস্থায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি কি এককভাবে, মৌলবাদী পশ্চাদপদ বিদেশীমদদপুষ্ট এ শক্তিকে মোকাবেল করতে সক্ষম?
এবারের ভোটের লড়াইয়ে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে বিজ্ঞজন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে যে সুযোগ দিয়েছে সে এক মহেন্দ্রক্ষন। এমন সুযোগ বার বার আসেনা। উনিশশো সত্তুরের নির্বাচনের ভোটে অনুরূপ সুযোগ হয়েছিল। পাকিস্তানীরা সে সুযোগকে কাজে লাগায়নি। উপরন্তু আমাদের যুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছিল। প্রায় অর্ধ শতাব্দি পরে আবার সে ধরনের একটি সুযোগ বাংলাদেশ পেয়েছে। এখনই সময় যতসব সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তনের কাজ সেরে নেয়ার।
দূর্ণীতি আমাদের রক্তে মিশে যাওয়া এক সর্বনাশা অভিশাপ। আমাদের দূর্ণীতির বাসরঘর উপরতলায়। এখনই আসল সময় উপরতলা থেকে ঝেঁটিয়ে দূর্ণীতিকে বের করে দেয়ার। ভোটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দেয়া এ সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে অভিশাপের সে বোঝা আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে যুগের পর যুগ। হয়তো কাঁধ থেকে কোনদিনই নামানো সহজ হবে না। আশার বিষয় সরকার দূর্ণীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।