আব্দুল ওয়াদুদ।। মৌলভীবাজার
মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানজুড়ে এখন কচি সবুজ রঙের ছোঁয়া লেগেছে। প্রতিটি পাতায় পাতায় বৃষ্টি মেখে এই সবুজ সদ্য অঙ্কুরণ। এই দৃশ্য দেখে মনে হবে বাগানগুলোতে সবুজের হাট বসেছে। বাগানের টিলা-সমতল প্রান্তরের যেদিখে দু’চোখ যাবে, ভেসে উঠবে শুধু সবুজের সমারোহ। সেই সতেজ আর স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে দু’টি পাতা একটি কুঁড়িরা এখন মাথা তুলে আপন ভুবনে মাতোয়ারা।
চায়ের রাজধানী মৌলভীবাজারের প্রতিটি বাগানসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তরের অবশিষ্ট চা বাগানের রূপ এখন এমন। সম্মিলিত সবুজের অপূর্ব জেগে ওঠা! কিছুদিন আগে এই চা গাছের মাথা ছাঁটাই করা হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতি বছর এভাবে চা গাছগুলোর মাথা নির্দিষ্ট মাপ অনুসারে কেটে ফেলা হয়। তারপর চলে অপেক্ষা। কবে বৃষ্টি দেবে, চা বাগানে কখন কুঁড়িরা চোখ মেলে তাকাবে সবুজাভ চেহারা নিয়ে। চা শ্রমিক, সর্দার এবং ব্যবস্থাপক এরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন এদিনটির জন্য। হঠাৎ বৃষ্টির দখলে পড়ে একসময় স্বস্তি ফিরে পায় চা গাছগুলো। সেই বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় উর্বর হয় প্রকৃতিও। আর এই প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে দেশ-বিদেশ থেকে চা বাগানগুলোতে ছুটে আসেন ভ্রমন পিপাসুরা। চা বাগানের পথ ধরে এগোলেই এখন চোখে পড়ে ঘনসবুজের ছড়াছড়ি। পাহাড়ি টিলার ধূসর মাটির বুক থেকে সেই সবুজ দেখে মনে হবে, প্রকৃতি সাড়া দিয়েছে সবুজের ডাক পড়েছে জাগরে তোরা সবাই জাগ।
সম্প্রতি মাতিউরা চা বাগানে গিয়ে দেখা গেলো শিশিরকণা গায়ে নিয়ে কুঁড়িরা মেতেছে। শিশিরের জলজ পরশে ঘনসবুজ পাতাগুলোর রূপসৌন্দর্য্য পাল্টে গেছে। সকালের সূর্যালোক তার কিরণটুকু নিয়ে এসে ভাগ বসাতে একটুকুও দেরি করেনি।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ জানান, ৬ মার্চ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে ৭৭ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই বৃষ্টিপাতের কারণে চা বাগানে এখন সবুজ জেগে উঠেছে। যা এক পলকে চোখের দৃষ্টি ও হৃদয়কে মুগ্ধ করবে বলে জানান আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের এই আবওয়াবিদ। বাগান শ্রমিকরা জানায়, প্রায় দু’মাস আগে কাটা হয়েছে গাছগুলো। কয়েকদিন আগের বৃষ্টি পেয়ে প্রায় মৃত থেকে জেগে উঠেছে ওরা।
ফুলছড়া চা বাগানের শ্রমিক পূর্ণিমা বাকতির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল চা বাগানের নতুন কুঁড়িগুলো তোলার অনুভূতি কেমন? তিনি জানান, এটা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। সব একই রকম লাগে। তবে বৃষ্টির পরে যে কুঁড়িগুলো বের হয় তা চকচকে সবুজ থাকে।
দেশে মোট ১৬৪টি চাবাগান রয়েছে। এর মধ্যে চায়ের রাজধানী মৌলভীবাজারে-৯১টি, হবিগঞ্জে-২৩টি, চট্টগ্রামে-২২টি, সিলেটে-২০টি, রাঙামাটিতে-১টি, ব্রাহ্মনবাড়িয়ায়-১টি, পঞ্চগড়ে-৫টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে-১টি। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাবাগান মৌলভীবাজার জেলায় হওয়াতে মৌলভীবাজারকে চায়ের রাজধানী বলা হয়। আর এই কারণে জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় চা নিলাম কেন্দ্রের দাবীতে বিভিন্ন আন্দোলন করছেন মৌলভীবাজারবাসী। মৌলভীবাজারের উল্যেখযোগ্য চা বাগান এর মধ্যে রয়েছে ফিনলে, ক্লিবডন, দিলদারপুর, মিতিংগা, শাহবাজপুর, সাতগাঁও, মাইজদিহি, মাথিউরা, রাজনগর প্রভৃতি চা বাগান।
ইস্পাহানি কোম্পানির চা বাগান ‘জেরিন টি এস্টেট’ এর ম্যানেজার সেলিম রেজা বলেন, নতুন কুঁড়ির জন্য আমরা অধীর আগ্রহে থাকি। আমরা যারা চা বাগানে কাজ করি তারা এমন আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি যে কখন কুঁড়ি গজাবে, তখন গাছ সবুজ হবে। বসন্ত এলে চারপাশের সবুজ প্রকৃতি দেখে হৃদয়ে যেভাবে দারুণ অনুভূতি হয়, ঠিক তেমনি বৃষ্টির পর চা গাছে নতুন কুঁড়িতে ভরে উঠতে দেখলে আমাদের হৃদয়ও গভীর আনন্দিত হয়ে উঠে। এই নতুন কুঁড়িই তো আমাদের চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখবে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) সূত্র জানায়, আগাম বৃষ্টিপাত চায়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী। চা-শিল্পের ১৬২ বছরের ইতিহাসে গত চা উৎপাদন মৌসুমে দেশে সর্বোচ্চ ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।