সৈয়দ বয়তুল আলী, মৌলভীবাজার।। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় মৌলভীবাজার জেলার ছোট ছোট পাহাড় ও টিলা বেষ্টিত কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ী বনজ এবং ফলজ বৃক্ষে সমৃদ্ধ বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে মধু চাষ। বিশেষ করে এই মধু চাষের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন এলাকার বেশির ভাগ নারীরা।তাই পুরুষের সাথে নারীরাও কর্মমুখি হয়ে উঠছেন। বাড়তি খরচ ছাড়াই একবার পূজি খাটিয়ে বারবার আয় করা যায় এই খাত থেকে। মধু বিক্রি করে সংসারের বাড়তি আয়ের যোগান দিচ্ছেন এলাকার প্রায় পাঁচশত পরিবার। বেকারত্ব কমার পাশাপশি আর্থিক স্বচ্ছলতাও এসেছে চাষীদের ঘরে।
জানাযায়, কমলগঞ্জ উপজেলার কাঁঠালকান্দি গ্রামের মধু শিকারি আজাদ মিয়ার হাত ধরে প্রায় দুই যুগ পূর্বে এই এলাকায় শুরু হয় মধু চাষ। ১৯৯৬ সালে আজাদ মিয়া পাহাড়ী বনের ভেতর পেয়ে গেলেন এক নতুন পথের সন্ধান। একদিন বনের ভেতর দেখা পেলেন মৌচাকের, সাথে রানি মৌমাছি। কৌশলে সেই রানিকে ধরে একটি স্থানে সূঁতো দিয়ে বেঁধে রাখলেন। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে অনেক পোকা (মৌমাছি) সেই রানির কাছে ছুটে আসে। তা দেখে সেই রানিকে বাড়িতে এনে একটি কাগজের বাক্সে রাখলেন। কয়েকদিনের মধ্যে সেই বাক্স ও বাক্সের আশপাশ মৌমাছির গুঞ্জনে সরব হয়ে ওঠে। চার মাসের মধ্যেই বাক্স থেকে মধু আহরণও করলেন। সেই থেকে আজাদ মিয়ার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে লাগলো।
আজাদ মিয়া বলেন, তিনি নি:স্ব ছিলেন এখন অনেক সুখে আছেন, ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারছেন কমে গেছে তার আর্থিক টানাপোড়েন। এদিকে মৌ চাষের খবর ছড়িয়ে পড়লো আশপাশে এলাকায়। বাতাসে মৌমাছির গুঞ্জণ, মধুর ঘ্রাণ। আজাদ মিয়া মৌ-চাষ পদ্ধতি বাড়ানোর লক্ষ্যে পাহাড় থেকে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করে কাঠের বাক্সে সেই রাণী এবং মৌমাছির কলোনী বিক্রি শুরু করেন। ইতোমধ্যেই এই চাষের প্রসার ঘটেছে বহুগুণ এবং সমৃদ্ধি এসেছে চাষীদের ঘরে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এলাকায় বিভিন্ন বাড়ির উঠোনের কোণে-আঙ্গিনায় একটা দুইটা বা তারও বেশি মৌমাছির বাক্স রয়েছে। পরিবারের মহিলারাই মূলত এগুলো দেখভাল করেন। মৌমাছি চাষে বাড়তি সময় ব্যায় করতে হয়না বাড়ীর আঙ্গিনায় মৌমাছির বাক্স (মৌমাছির কলোনি) স্থাপন করে পিপঁড়াসহ অন্যান্য পোকামাকড়ের হাত থেকে একে রক্ষা করলেই বছরে দুই থেকে তিনবার মধু সংগ্রহ করা যায়। ফুল ফলের মৌসুমে বেশি মধু পাওয়া যায়।
কমলগঞ্জের উপজেলার আদমপুর, মাধবপু, ইসলামপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি, মধ্যভাগ, উত্তর ভাগ, নৈনারপাড়, জালাল পুর, ছয়ঘড়ি, ভানুবিল, নোয়া গাঁওসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় পাঁচশত পরিবার ইতোমধ্যে মধুচাষের সাথে যুক্ত হয়েছে। কর্মসংস্থানসহ পরিবারে বাড়তি আয়ের ক্ষেত্র তৈরী করেছে মৌচাষ। কাঁঠালকান্দি গ্রামের গৃহবধু ফুলু বেগম জানান, স্বামীর আয়ে সংসার চলতনা অনেক টানাপোড়েন ছিলো মধুচাষে যুক্ত হবার পর তাদের আয় বেড়েছে কমেছে অভাব অনটন। উত্তরভাগ গ্রামের মধুচাষী আব্দুল মোছাব্বির তালুকদার বলেন, সাতবছর আগে একটি বাক্স (মৌমাছির কলোনী) দিয়ে চাষ শুরু করেন তিনি বর্তমানে তার আটটি বাক্স রয়েছ। এটি লাভজনক বলে তিনি আরো বাক্স বাড়াতে চান। বছরে একটি বাক্স থেকে সর্বোচ্ছ পঁচিশ লিটার মধু পাওয়া সম্ভব। প্রতি লিটার মধু তারা আটশত থেকে নয়শত টাকায় বিক্রি করেন।
কোনাগঁও গ্রামের মঙ্গল মিয়া বলেন,আমার বাড়িতে ৭টি মধুর কাচা আছে। এগুলো বেশি দেখা শোনা করেন আমার স্ত্রী।
মধুচাষী উন্নয়ন সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মোতালিব জানান, তারা বর্তমানে দেশী দাশকুলি প্রজাতির মৌমাছির চাষ করছেন। এই মৌমাছির চাক থেকে বছরে দুইবার মধু আহরণ করা যায় এবং প্রতিটি চাক থেকে বছরে বিশ থেকে পঁচিশ লিটার মধু পাওয়া যায়। তবে এর চাইতেও লাভজনক মৌমাছি হচ্ছে আফ্রিকান প্রজাতি। বিদেশ থেকে এই মাছি কিনে আনতে হয়। আর্থিক কারনে তারা এই মৌমাছি কিনতে পারছেননা।
মধু চাষের এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আধুনিক প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন বলে জানান, মধুচাষী উন্নয়ণ সমিতির সভাপতি আলতাফ আহমদ তালুকদার(বাবুল)। বলেন মধু চাষের সঙ্গে দিনদিন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। তাদের সুদবিহীন ও স্বল্প সুদের ঋণ দেয়া দরকার। সরকার থেকে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশে মধুর চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।
শিল্প সহায়ক কেন্দ্র বিসিক মৌলবীবাজারের উপ-ব্যবস্থাপক মো.মাহবুবুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকজন মধু চাষীকে তারা স্বল্প টাকার ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং বিনা মূলে বক্স দিয়েছেন। যারা এখনও প্রশিক্ষণ নেয়নি তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যাবস্থা করবেন। এবং তাদের তদারকি সব সময় অব্যাহত রয়েছে।