হারুনূর রশীদ।।
মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের শুধু রাজনীতি নয় সর্বাঙ্গীন জীবনে এতো বহুল ব্যবহৃত দু’টি শব্দ যে নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন যেমন পড়েনা তেমনি নতুন করে কি ভাষা ব্যবহারে লিখতে হবে আমার জানা নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বাত্মক সাহায্য করেছে এটি যেমন সূর্যের মত সত্য তেমনি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই দেশ নয়মাসে স্বাধীন হতে পেরেছে সেটিও নিখাদ সত্য। এই মুক্তিযোদ্ধারা দু’ভাবে বা দু’নমুনায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এক পক্ষ সরাসরি অস্ত্রহাতে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন। আরেক পক্ষ মুক্তিসৈনিকদের রসদ দিয়ে প্রয়োজনে থাকার জায়গা করে দিয়ে, প্রচার ও প্রচারণায় শরিক হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এ দু’নমুনার কাজে প্রত্যক্ষভাবে যারা অংশ নিয়েছেন আমার মতে তারাই মুক্তিযোদ্ধা। ভারতের কাছে ছবিসহ এ সকল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা রয়েছে এবং বাংলাদেশ এ তালিকা সংগ্রহ করেছে বলেই আমরা শুনেছি।
আরেক পক্ষ আমাদের নির্যাতিত নারী সমাজ। এদের সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এমন নয় কিন্তু মুক্তিযু্দ্ধের কারণে তাদের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বেদনাদায়ক, লোমহর্ষক ধর্ষণের সাথে চরম লাঞ্চনা-নির্যাতনের মুখে পতিত হতে হয়েছিল যার হিসেব দেয়ার প্রয়োজন নেই। এ পরিসরে সম্ভবও নয়। অতএব খুবই সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দু’টির আবেদন যতদিন মু্ক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে ততদিনই মানুষের মাঝে অব্যাহত থাকবে। ‘মু্ক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে’ বাক্যাংশটি এজন্যই লিখলাম স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আজও দেখি একদিকে ‘মু্ক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ’কে নিয়ে রাজনীতি সমানতালে চলছে। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবহেলা, স্বজনপ্রীতি আর নব নব নমুনায় মু্ক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির অনৈতিক দুর্ণীতিও যে চলছেনা এমন হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না। অবস্থায় এমনই মনে হয় যেনো এখানে শক্তভাবে হাল ধরতে কেউ রাজী নয় কিংবা শক্তভাবে হাল ধরার প্রয়োজনও কেউ অনুভব করছেন না। পরোক্ষভাবে একটি উদাহরণের কথা বলতে পারি যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্বচ্ছ তালিকা হবার কথা কোন একটি বিশেষ জেলায়। কিন্তু, একজন আইনের আশ্রয়ে গেল আর অমনি তালিকা প্রণয়ন কিংবা তার ঘোষণা বন্ধ হয়ে গেল। সেই যে বন্ধ হয়ে গেল আর কোন খবর নেই। কেনো এমন হবে। যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতেই পারে, সে তার অধিকার। কিন্তু এ কারণে জাতির একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক মৌলিক বিষয়ের কার্যক্রম আইনের মারপ্যাঁচে আটকা পড়বে কেনো! মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় আর দেশের বিচার বিভাগ অবশ্যই বুঝেন এটি জাতির অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর সুরাহা, জাতিকে সত্যিকার অর্থে গড়ে তুলতে নিয়ামক শক্তি।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলার কাহিনী নতুন কিছু নয়। একটি বিষয় সত্য আর তা’হল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় নকল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগীতা বা আরো খাবাপভাবে বললে পায়তারা। বিশেষকরে যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তারাই শুরু করে ভূঁয়া মুক্তিযোদ্ধা সাজার কাজ। একদিকে নিজেদের কুকর্মের বিচার এড়িয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা, সাথে সাথে নব্যগঠিত দেশে লুটপাটের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। এখানে উল্লেখ্য জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা মহামতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বচ্ছ তালিকা তৈরীর কথা বলেছিলেন কিন্তু তাকে তো আর বাঁচতেই দেয়া হয়নি। তাঁকে হত্যার এটিও একটি কারণ ছিল।
এই মুক্তিযোদ্ধাগন, যাদের অমানবিক ভোগান্তি, নির্যাতন ও নিকাশে আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেলাম তাদের প্রতি জাতীয়ভাবে আমাদের দায়ীত্ব বা কর্তব্য বলে দেয়ার ধৃষ্টতা আমি দেখাতে চাই না। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন বৈসাদৃশ্য দেখি তখন নীরব থাকা যায় না।
এমনি এক মুক্তিযোদ্ধার ভিক্ষে করে জীবন ধারণের কাহিনী আজই চোখে পড়লো “প্রতিদিন২৪.কম” নামের একটি অনলাইনে। লিখেছেন একজন রোয়াজ আহমদ। রোয়াজ আহমদ তার নিজের ভাষায় লিখেছেন- “যাদের জন্য আমরা একটা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি তারা আজও না খেয়ে অবহেলায় পড়ে আছে রাস্তায়।
চট্রগ্রামের গোল পাহাড় মোড়ে এক বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষুককে সংবাদপত্র পড়তে দেখে fb ব্যাক্তিত্ব Muslehuddin Mohammed Badrul ভাই আগ্রহ নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে জানতে পারেন তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা! মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, বয়রা গ্রামের আব্দুস সাত্তার নামের এই মুক্তিযোদ্ধা 1968 সালে ঢাকা কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। 1971 সালে মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীতে থেকে যুদ্ধ করেছেন। বর্তমানে সংসারে তাঁর কেউ নেই। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দীর্ঘদিন মেডিকেলে ছিলেন। 27 বছর ধরে চট্টগ্রামে আছেন। রাতে থাকেন দামপাড়া পেট্রোল পাম্পের বারান্দায়। 76 বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা কথা বলার সময় অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন শুদ্ধ ইংরেজীতে।”
“একথা ঠিক যে, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা সঠিক মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রনয়ন করতে পারিনি! অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রের সুবিধা নিচ্ছে! অন্যদিকে আসল মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম না থাকায় রাষ্ট্রের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এমনকি কেউ কেউ ভিক্ষাও করছেন! একইভাবে বীরাঙ্গানারাও বঞ্চিত হচ্ছেন এবং ভিক্ষাবৃত্তি করে কিংবা কারো গৃহে কাজ করে মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের অনুরোধ, যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে এই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারসহ সুবিধা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।”