নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (প্রশাসনিক কর্মকর্তা) দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর ৯টি ধারা এবং এর সংশ্লিষ্ট উপধারাগুলোও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে পুরো আইনটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর আঘাত করেছে। এটি ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতিরও পরিপন্থী। রায়ে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্মকমিশনের সব সদস্য প্রশাসনিক নির্বাহী। একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারে না।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের ডিভিশন বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেন। আইন বিশেষজ্ঞরা এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, এই রায় ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে। এই রায়ের ফলে বিদ্যমান আইন দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা সম্ভব নয়। মোবাইল কোর্ট করতে হলে সরকারকে আইন সংশোধন এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটকে তা পরিচালনার ক্ষমতা দিতে হবে।
২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কার্যক্রমও বাতিল হয়ে যায়। তারপর ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট আইন জারি করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংসদে এই অধ্যাদেশটি পাস না করায় তা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে এসে আরেকটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর এসথেটিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান খান প্রথমে মোবাইল কোর্টের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন।
টয়েনবি সার্কুলার রোডে অবস্থিত একটি বহুতল ভবনের মালিক মো. মজিবুর রহমান একই বছরের ১১ ডিসেম্বর আরেকটি রিট করেন। মোবাইল কোর্ট তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেয়। আইনের বৈধতা এবং অর্থ ফেরতের দাবিতে তিনি এই রিটটি করেন। ২০১২ সালে দিনাজপুরের বেকারি মালিকদের পক্ষে মো. সাইফুল্লাহসহ ১৭ জন রিট করেন। এতে বেকারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি সঙ্গে রেখে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চাওয়া হয়। তিনটি রিট আবেদনের ওপরই হাইকোর্ট সরকারের উপর রুল জারি করেন। এ নিয়ে হাইকোর্টে দীর্ঘ শুনানির পর বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করা হয়।
রায়ে বলা হয়, মোবাইল কোর্ট আইনের ধারা ৫, ৬ (১, ২, ৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০, ১১, ১৩ ও ১৫ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ধারাগুলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে (নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ) ক্ষমতার পৃথকীকরণ-সংক্রান্ত সংবিধানের দুটি মৌলিক কাঠামোর বিরোধী। তবে আদালত অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা ও বিতর্ক এড়াতে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হওয়া এই তিনটি রিটের বিষয় ছাড়া মোবাইল কোর্টের দেওয়া সব আদেশ, সাজা ও দণ্ডাদেশ অতীত বিবেচনায় সমাপ্ত বলে মার্জনা করেছেন।
রায়ে বলা হয়, প্রশাসনিক নির্বাহী হিসেবে মোবাইল কোর্টে নিয়োজিতরা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না, কেননা মাসদার হোসেন মামলায় রায়ে এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। এছাড়া এর সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো ‘কালারেবল প্রবিশন’। এটি সরাসরি মাসদার হোসেন মামলার রায়ের চেতনার পরিপন্থী। রায়ে আরো বলা হয়, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংসদের করা আইনের তফসিল এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেবল একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিল সংশোধন করতে সরকার কেন এবং কিভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলো, তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কোনো আইন সংশোধনের ক্ষমতা প্রধানত সংসদের। ওই আইনের তফসিল সংশোধনের ১৫ ধারা বলে সংসদ সেই ক্ষমতা সরকারের অনুকূলে দিয়েছে। সংসদ আইনের অধীন বিধিবিধান তৈরির ক্ষমতা সরকার বা অন্য কর্তৃপক্ষের অনুকূলে দিতে পারে। কিন্তু মূল সংবিধি সংশোধনে সংসদের যে প্রধান ক্ষমতা, তা কাউকে দিতে পারে না। আইনের ১৫ ধারাবলে এই আইনের তফসিল সংশোধনের ক্ষমতা হস্তান্তর করে সংসদ নিঃসন্দেহে ক্ষমতা পৃথককরণের ধারণাকে লঙ্ঘন করেছে। ক্ষমতার পৃথককরণ আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ।
এদিকে গ্রাম্য সালিশ আইন ও মোটর পরিবহন আইন অনুযায়ী পুলিশের জরিমানার বিধানের বিষয়টি এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ উদাহরণ হিসেবে এনেছিল, আদালত তা বিবেচনায় নেয়নি। গ্রাম্য আদালত ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে। মোটর পরিবহন আইন অনুযায়ী পুলিশও জরিমানা করে। আদালত বলেছেন, গ্রাম্য আদালত ও পুলিশ অ্যাক্টের অধীনে তারা এটা করে। কিন্তু তারা কোনো জেল দণ্ড দেয় না শুধু জরিমানা করে।
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। তিনি বলেন, মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে ১০০টি আইনের অপরাধের বিচার ও দণ্ড দেওয়া যেতো। হাইকোর্টের রায়ের ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। তবে ওই ধরনের কোনো অপরাধ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টিগোচর হলে তাত্ক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে থানায় সোপর্দ করতে পারবেন।
মোতাহার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, যেসব ধারা আদালত বাতিল করেছে এরপরও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট কি না ও বিদ্যমান আইনটি সংশোধন বা নতুন করে আইন হবে কি না সে সিদ্ধান্ত সরকার নেবে। ইত্তেফাকের খবর।